প্রতি মূহুর্ত্যে পৃথিবীতে আল্লাহর নাম ইথারে ভেসে বেড়ায়।

সেপ্টেম্বর 21, 2010

মুয়াযযিন উচ্চৈঃস্বরে দাঁড়ায়ে মিনার ‘পরে

কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে!

জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।

আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।

মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমধুর

আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।… কায়কোবাদ।

হ্যাঁ এই আযানকে নিয়ে আমার আজকের এই পোস্ট। কবি কায়কোবাদের মত করে আমি কখনো আযান শুনি নাই, বা আযান নিয়ে কখনো ভাবি নাই। আযান আমার কাছে দিনে আরো ১০টি নিত্য ঘটে যাওয়া বিষয়ের মত লাগলতো।

কিন্তু আযান যে, দিন-দুনিয়ার ভুলে যাওয়া মানূষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, হে মানুষ আস, এই দুনিয়ার কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প কিছু সময় ব্যয় কর-সেই আল্লাহ নামে, যিনি তোমাকে এক শুণ্য থেকে একদিন সৃষ্টি করেছিলেন।

আর এই আহ্বান প্রতিমুহুর্ত্যে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও মুয়াজ্জিন স্মরন করিয়ে দিয়ে চলছেন নিরবদি, তা সে ভাবে কখন মনে হয় নাই। এ যেন শুধু আযান নয়, যেন তৌহিদের এক তরংগ~ পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে —তা ক্রমাগত– বিরামহীন ভাবে– পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। এই আহ্বান ক্রমাগত চক্রাকারে বহে চলছে, আর তা ক্রমাগত বিস্তৃর্ন হচ্ছে। আর পৃথিবী বাসিকে আহ্বান জানাচ্ছে- হাই আলার সালাহ- হাই আলার ফালাহ – আসো কল্যাণের পথে—আসো শান্তির পথে.।

স্বাভাবিক ভাবে মুয়াজ্জিন যখন আযান করেন তখন প্রতি আযানে ৪ মিনিট সময় ব্যয় হয়ে থাকে।

আপনারা জানেন যে আমাদের এই পৃথিবীকে ৩৬০ longitudes তে ভাগ করা হয়েছে, এবং ১ ভাগ থেকে আরেক ভাগের সময়ের ব্যবধান ৪ মিনিট।

আর এই আযান শুরু হয় ১ longitudes এলাকা থেকে, ১ longitudes এলাকার আযান শেষ হলে পর ২ longitudes এলাকায় আযান শুরু হয়, আর এভাবে ক্রমান্নে আযান এক longitudes এলাকা থেকে আরেক longitudes এলাকায় চলে চলে। ৩৬০ longitudes পুর্ণ করে।

এইটি সোজা এক গানিতিক হিসাব করে দেখুন-

৪x৩৬০(longitudes) = ১৪৪০ মিনিট
১৪৪০ মিনিট /৬০ মিনিট= ২৪ ঘন্টা। তার মানে আযানের আহ্বান এই দুনিয়ায় কখনো বন্ধ হয়না।

এবার ভৌগলিক ভাবে এক নজর দেখে নেই-

পৃথিবীর মানচিত্রে সবচেয়ে পূর্ব প্রান্তের মুসলিম দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া । এ দেশের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে সাবিল, জাভা, সুমাত্রা, বর্নিয়া । রাতের অন্ধকার কেটে গেলে স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে প্রভাতের আগমনকে স্বাগত জানাতে সাবিল থেকে শুরু হয় হাজার হাজার ইন্দোনেশীয় মোআজ্জিনদের কন্ঠের সুমধুর আজানের প্রতিধ্বনি। ফজরের আজানের এই প্রক্রিয়া ক্রমেই এগিয়ে চলে পশ্চিমের দিকে।
সাবিলের আজান শেষ হওয়ার প্রায় দেড় ঘন্টা পরই জাকার্তায় প্রতিধ্বনিত হয় আজানের সুর। এর পরই সুমাত্রায় শুরু হয় আজানের এই পবিত্র প্রক্রিয়া, ইন্দোনেশিয়ার পরিসরে শেষ হওয়ার পূর্বেই তা শুরু হয়ে যায় পরবর্তী মুসলিম দেশ মালয়শিয়ায় ।
বার্মার স্থান রয়েছে এর পরপরই, এবং জাকার্তায় শুরু হওয়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আজানের সুর পৌঁছে যায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশের পর আজানের জয়যাত্রা ধ্বনিত হয় পশ্চিম ভারতের বুকে, কলকাতা থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত এবং তারপর এগিয়ে যায় বোম্বের দিকে । শ্রীনগর এবং শিয়ালকোট (পাকিস্তানের উত্তরের একটি শহর ) শহর দু’টিতে আজানের সময় একই সাথে শুরু হয়। শিয়ালকোট, কুয়েটা এবং করাচির মধ্যে সময়ের পার্থক্য চল্লিশ মিনিটের মত । তাই এ সময়ের মধ্যে সমগ্র পাকি¯তান জুড়ে শোনা যায় আজানের সুর। সেই সুর পাকিস্তানে মিলিয়ে যাবার আগেই আফগানিস্তান আর মাস্কাতে এর ঢেউ এসে লাগে। বাগদাদের সাথে মাস্কাতে সময়ের পার্থক্য এক ঘন্টার। আজানের আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয় ‘হিযায-ই-মুকাদ্দাস’ (মক্কা ও মদিনার পবিত্র শহরসমূহ), ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এবং ইরাকের আকাশে- বাতাসে।
বাগদাদ এবং মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার সময়ের পার্থক্যও এক ঘন্টা । তাই এ সময়ের মধ্যে সিরিয়া, মিশর, সোমালিয়া এবং সুদানে চলতে থাকে আজান। পূর্ব ও পশ্চিম তুরস্কের মধ্যে ব্যবধান দেড় ঘন্টার, এ সময়ের মাঝে সেখানে নামাজের আহ্বান শোনা যায়।
আলেকজান্দ্রিয়া এবং ত্রিপলি ( লিবিয়ার রাজধানি ) এক ঘন্টার ব্যবধানে অবস্থিত। একই ভাবে আজানের প্রক্রিয়া সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে চলতে থাকে। তাওহিদ এবং রিসালাতের প্রচারের যে ধারা শুরু হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ায় তা এসে আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব ঊপকূলে পৌছে সাড়ে নয় ঘন্টা পর। ফজরের আজানের বার্তা আটলান্টিকের ঊপকূলে পৌছাবার পূর্বে ইন্দোনেশিয়ার পূর্বাঞ্চলে যোহরের আজানের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং ঢাকায় এটা পৌছানোর পূর্বে শুরু হয়ে যায় আছরের আজান। দেড় ঘন্টার মত সময় পেরিয়ে এ প্রক্রিয়া যখন জাকার্তায় পৌছে ততক্ষনে সেখানে মাগরিবের সময় হয়ে আসে, এবং মাগরিবের সময় সুমাত্রায় শেষ না হতেই সাবিলে এশার আজানের আহ্বান ভেসে আসে।
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই আমাদের চোখে পড়বে আজানের অবাক করা দিকটি আর তা হলো পৃথিবীর বুকে প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও হাজার হাজার মোআজ্জিনের গলায় আজানের সুর ভেসে বেড়ায়। এমনকি আপনি যে মুহূর্তে এ অংশটি পড়ছেন , নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ঠিক এই মুহূর্তেও এই পৃথিবীর কোথাও না কোথায় অন্তত হাজার খানেক মানুষ শুনতে পাচ্ছে আজানের সুর, মোআজ্জিনদের গলায়, আর এমনি করে সে আহ্বান ভেসে বেড়াচ্ছে ইথারে প্রতিটি মুহূর্তে । নিচের ভিডিও টি দেখুন তাহলে বুঝতে আর সহজ হবে হয়তো।


মূল- সাইয়েদ মাহবুব আলম। অনুবাদ- মহিউদ্দিন।
.

ফেসবুকে লেখা বা পড়ার জন্য সহায়ক কিছু টিপস।

অগাষ্ট 29, 2010

অনেকে যখন নতুন আসেন ফেসবুকে তখন তারা ফেসবুকের বাংলা লেখা খুব ছোট দেখে থাকেন। যা অনেকের পক্ষে পড়া বা বুঝা সম্ভব হয়ে উঠেনা। আমি নিজেও এই একই অসুবিধার সম্মুখিন হয়েছিলাম।
তাই যারা নতুন যারা বাংলায় লেখতে চান, এবং পড়তে চান তাদের জন্য আমার এই লেখা। আমার এই নির্দেশিত পথ আপনাকে শুধু ফেসবুক নয়, বাংলা ব্লগ গুলো যেমন- ওয়ার্ডপ্রেস নির্ভর ব্লগ, মজিলা বা গুগুলেও বাংলা টাইপ গুলো পরিষ্কার দেখাতে সাহায্য করবে।

এর জন্য প্রথমে আপনি এই লিংক থেকে গিয়ে গিয়ে সুলাইমান লিপি ফন্ট ডাউনলোড করেন। আর এই পেজের নির্দেশ মত তা আপনার পিসিতে ইন্সটল করেন।

২য়তঃ আপনি এই পেজে গিয়ে ৪টি লিংক পাবেন, তার থেকে যে কোন একটি লিংক থেকে অভ্র ইউনিকোড সফট ওয়ার ডাউন লোড করেন। তারপর আপনার পিসিতে ইন্সটল করেন। ইন্সটল করার পর আপনার ডেক্সটপের কোনে এইরূপ একটি কালো বার আসবে

করার পর আপনি F12 চাপ দিয়ে লিখতে শুরু করুন। বিন্দাস লিখতে পারবেন বাংলা আবার ইংরেজি লিখতে গেলে F12তে চাপুন এবার ইংরেজিতে লিখতে পারবেন।

৩। এবার এই সাইট থেকে ফন্ট ফিক্সার ডাউনলোড করে আপনার পিসিতে ইন্সটল করুন। এবং যে বক্স আসবে তাতে সুলাইমান ফন্ট সিলেক্ট করে ওকে করুন। ব্যাস আপনার সামনে যাদুর মতো সব ফকফকা হয়ে আসবে। .

The marriages of Prophet Muhammad

জুলাই 7, 2010

To complete the discussion one has to examine the marriages of Prophet Muhammad. These marriages are no problem for a Muslim who understands the ideal character of the Prophet and the circumstances under which his marriages were contracted. But quite often they stand as a stumbling block for non-Muslims to understand the personality of the Prophet, and cause irresponsible and premature conclusions, which are not to the credit of Islam or the Prophet. Here we shall not give any conclusions of our own or denounce the conclusions of others. We shall present certain facts and let the readers see for themselves.

1. The institution of marriage as such enjoys a very high status in Islam. It is highly commendable and essential for the sound survival of society.

2. Muhammad never said that he was immortal or divine. Time and again, he emphasized the fact that he was mortal chosen by God to deliver God’s message to mankind. Although unique and distinguished in his life, he lived like a man and died as a man. Marriage, therefore, was natural for him, and not a heresy or anathema.

3. He lived in an extremely hot climate where the physical desires press hard on man, where people develop physical maturity at an early age, and where easy satisfaction was a common thing among people of all classes. Nevertheless, Muhammad had never touched women until he was twenty-five years of age, when he married for the first time. In the whole Arabia he was known by his unimpeachable character and called al-Ameen, a title which signified the highest standard of moral life.

4. His first marriage at this unusually late stage in that area was to Lady Khadeejah, an old twice-widowed lady who was fifteen years senior to him. She herself initiated the contract, and he accepted the proposal in spite of her older age and in spite of her being twice- widowed. At the time he could have quite easily found many prettier girls and much younger wives, if he were passionate or after things physical.

5. With this lady alone, he lived until he was over fifty years of age, and by her he had all his children with the exception of Ibraheem. She lived with him until she passed the age of sixty-five, and in her life he never had any other marriage or any other intimacy with anybody besides his only wife.

6. Now he proclaimed the message of God, and was well over fifty and she over sixty-five years of age. Persecutions and perils were continually inflicted on him and his followers. In the middle of these troubles, his wife died. After her death, he stayed without any wife for some time. Then there was Sawdah, who had emigrated with her husband to Abyssinia in the early years of persecutions. On the way back her husband died and she sought a shelter. The natural course for her was to turn to the Prophet himself for whose mission her husband had died. The Prophet extended his shelter and married her. She was not particularly young or pretty and pleasant. She was an ordinary widow with a quick and loose temper. Later in the same year, the Prophet proposed to a minor girl of seven years, Aishah, the daughter of his dear companion Abu Bakr. The marriage was not consummated till some time after the migration to Medina. The motives of these two marriages can be understood to be anything except passions and physical attractions. However, he lived with the two wives for five to six years, up to his fifty-sixth year of age, without taking any other wife.

7. From his fifty-sixth year up to the sixtieth year of his life, the Prophet contracted nine marriages in quick succession. In the last three years of his life he contracted no marriages at all. Most of his marriages were contracted in a period of about five years, when he was passing the most difficult and trying stage in his mission. It was at that time that Muslims were engaged in decisive battles and entangled in an endless circle of trouble from within as well as from without. It was at that time that the Islamic legislation was in the making, and the foundations of an Islamic society were being laid down. The fact that Muhammad was the most dominant figure in these events and the center around which they revolved, and that most of his marriages took place during this particular period is an extremely interesting phenomenon. It invites the serious attention of historians, sociologists, legislators, psychologists, etc. It cannot be interpreted simply in terms of physical attractions and lustful passions.

8. Muhammad lived a most simple, austere, and modest life. During the day he was the busiest man of his era as he was Head of State, Chief Justice, Commander-in-Chief, Instructor, etc., all at once. At night he was the most devoted man. He used to stay one to two-thirds of every night vigilant in prayers and meditation (Qur’an, 73:20). His furniture consisted of mats, jugs, blankets and such simple things, although he was the king and sovereign of Arabia. His life was so severe and austere that his wives once pressed him for wordly comforts but they never had any (cf. Qur’an, 33:48). Obviously, that was not the life of a lustful and passionate man.

9. The wives he took were all widows or divorced with the exception of one minor girl, Aishah. None of these widowed and divorced wives was particularly known for physical charms or beauties. Some of them were senior to him in age, and practically all of them sought his hand and shelter, or were presented to him as gifts but he took them as legal wives.

This is the general background of the Prophet’s marriages, and it can never give any impressions that these marriages were in response to physical needs of biological pressures. It is inconceivable to think that he maintained so large a number of wives because of personal designs or physical wants. Anyone, a friend or a foe, who doubts the moral integrity or the spiritual excellence of Muhammad on account of his marriages has to find satisfactory explanations of questions like these: Why did he start his first marriage at the age of 25 after having had no association with any female? Why did he choose a twice-widowed older lady who was 15 years senior to him? Why did he remain with her only until her death when he was over fifty? Why did he accept all those helpless widows and divorcees who possessed no particular appealing qualities? Why did he lead such an austere and hard life, when he could have had an easy and comfortable course? Why did he contract most of his marriages in the busiest five years in his life, when his mission and career were at stake? How could he manage to be what he was, if the harem life or passions overtook him? There are many other points that can be raised. The matter is not so simple as to be interpreted in terms of manly love and desire for women. It calls for a serious and honest consideration.

Reviewing the marriages of Muhammad individually one does not fail to find the actual reasons behind these marriages. They may be classified as follows:

1. The Prophet came to the world as an ideal model for mankind, and so he was in all aspects of his life. Marriage in particular is a striking illustration. He was the kindest husband, the most loving and cherishable partner. He had to undertake all stages of human experience and moral test. He lived with one wife and with more than one, with the old and the young, with the widow and the divorcee, with the pleasant and the temperamental, with the renowned and the humble; but in all cases he was the pattern of kindness and consolation. He was designated to experience all these variant aspects of human behavior. For him this could not have been a physical pleasure; it was a moral trial as well as a human task, and a hard one, too.

2. The Prophet came to establish morality and assure every Muslim of security, protection, moral integrity and a decent life. His mission was put to the test in his life and did not stay in the stationary form of theory. As usual, he took the hardest part and did his share in the most inconvenient manner. Wars and persecutions burdened the Muslims with many widows, orphans and divorcees. They had to be protected and maintained by the surviving Muslim men. It was his practice to help these women get resettled by marriage to his companions. Some women were rejected by the companions and some others sought his personal patronage and protection. Realizing fully their conditions and sacrifices for the cause of Islam, he had to do something to relieve them. One course of relief was to take them as his own wives and accept the challenge of heavy liabilities. So he did and maintained more than one wife at a time which was no fun or easy course. He had to take part in the rehabilitation of these widows, orphans and divorcees because he could not ask his companions to do things which he himself was not prepared to do or participate in. these women were trusts of the Muslims and had to or participate in. These women were trusts of the Muslims and had to kept jointly. What he did, then, was his share of responsibility, and as always his share was the largest and heaviest. That is why he had more than one wife, and had more wives than any of his companions.

3. There were many war prisoners captured by the Muslims and entitled to security and protection. They were not killed or denied any right, human or physical. On the contrary, they were helped to settle down through legal marriages to Muslims instead of being taken as concubines and common mistresses. That also was another moral burden on the Muslims and had to be shouldered jointly as a common responsibility. Here, again, Muhammad carried his share and took some responsibilities by marrying two of those captives.

4. The Prophet contracted some of his marriages for sociopolitical reasons. His principal concern was the future of Islam. He was most interested in strengthening the Muslims by all bonds. That is why he married the minor daughter of Abu Bakr, his First Successor, and the daughter of Umar, his Second Successor. It was by his marriage to Juwairiah that he gained the support for Islam of the whole clan of Bani al-Mustaliq and their allied tribes. It was through marriage to Safiyah that he neutralized a great section of the hostile Jews of Arabia. By accepting Mary the Copt from Egypt as his wife, he formed a political alliance with a king of great magnitude. It was also a gesture of friendship with a neighboring king that Muhammad married Zaynab who was presented to him by the Negus of Abyssinia in whose territory the early Muslims found safe refuge.

5. By contracting most of these marriages, the Prophet meant to eliminate the caste system, the racial and national vanities, and the religious prejudices. He married some of the humblest and poorest women. He married a Coptic girl from Egypt, a Jewess of a different religion and race, a negro girl from Abyssinia. He was not satisfied by merely teaching brotherhood and equality but he meant what he taught and put it into practice.

6. Some of the Prophet’s marriages were for legislative reasons and to abolish certain corrupt traditions. Such was his marriage to Zaynab, divorcee of the freed slave Zaid. Before Islam, the Arabs did not allow divorcees to remarry. Zaid was adopted by Muhammad and called his son as was the custom among the Arabs before Islam. But Islam abrogated this custom and disapproved its practice. Muhammad was the first man to express this disapproval in a practical way. So he married the divorcee of his “adopted” son to show that adoption does not really make the adopted child a real son of the adopting father and also to show that marriage is lawful for divorcees. Incidentally, this very Zaynab was Muhammad’s cousin, and had been offered to him for marriage before she was taken by Zaid. He refused her then, but after she was divorced he accepted her for the two legislative purposes: the lawful marriage of divorcees and the real status of adopted children. The story of this Zaynab has been associated in some minds with ridiculous fabrications as regards the moral integrity of Muhammad. These vicious fabrications are not even worth considering here (see Qur’an, 33:36,37,40)

These are the circumstances accompanying the Prophet’s marriages. For the Muslims there is no doubt whatsoever that Muhammad had the highest standards of morality and was the perfect model for man under all circumstances. To non-Muslims we appeal for a serious discussion of the matter. They, then may be able to reach sound conclusons.

Islam In Focus – By DR. Hammudah Abdalati

বিশ্ব কাপ ২০১০

জুন 16, 2010

Your Browser Do not Support Iframe

ইসলামের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র

মে 11, 2010

আজকাল ব্লগিয় সূযোগ সুবিধায় মানুষ জন অনেক অনেক বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। এর মধ্যে গণতন্ত্র ও ইসলাম বিষয়ক আলোচনা হয়। তবে বেশীর ভাগ আলোচকের আলোচনা থেকে বুঝা যায় ঐ সব আলোচকের বর্তমান যুগ সম্পর্কে কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারণা লালন করেন না। বরং এক ধরণের অস্বাভাবিক মানসিকতায় আচছন্নে ডুবে আছেন।
এ ধরণের একটি তাত্ত্বিক বিষয়ে সঠিক ধারণা পেতে হলে প্রয়োজন এ সম্পর্কে জানাশোনা এবং পড়াশুনার জন্য চেষ্টা করা। সে উদ্দেশ্যেই পাঠকদের জন্য এ লেখটি দেয়া হল। লিখেছেন শাহ আব্দুল হান্নান, চিন্তাবিদ ও সাবেক সচিব। যারা গভীরভাবে বিষয়টি বুঝতে চান লেখাটি তাদের কাজে লাগবে আশা করি।

ইসলামের প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র
শাহ আব্দুল হান্নান

বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্র একটি পরিচিত শব্দ। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য সংশ্লিষ্ট দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র আধুনিক বিশ্বে একটি স্বীকৃত ও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা। অন্যদিকে দেখঅ যায় গণতন্ত্র সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিভিন্ন মতামত। বিভিন্ন ইসলামী দলে এজেন্ডায় রয়েছে গণতন্ত্রের কথা, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। আবার এমন সব দল বা ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা যায়, যারা গণতন্ত্রকে ইসলামসম্মত মনে করেন না, কেননা গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে আমাদের সূক্ষ্ম এ গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। শব্দগত মারপ্যাচের উর্ধ্বে গিয়ে বিষয়টি ভালভাবে বোঝা দরকার। আমরা দেখছি আধুনিক বিশ্বে ইসলামী দলসমূহ ও ব্যক্তিবর্গ, ইসলামী পন্ডিতগণ এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেন যেখানে সরকার পার্লামেন্টের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করবে। সকলের মত প্রকাশের অধিকার তথা ভোটাধিকার থাকবে, আইনের শাসন থাকবে, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা থাকবে, সংবাদপত্রের স্বাধনিতা থাকবে, মৌলিক মানবাধিকার রক্ষিত হবে ইত্যাদি। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হয় তখন তার পূর্বশর্ত হিসেবে এসবের কথাই বলা হয়। অর্থাৎ গভীর বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ইসলামী দলগুলোর সরকার ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গঠন কাঠামো একই ধরণের।

তত্ত্বগতভাবে বলা যায় যে, কেবল সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে যখন ইসলামে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মুখ্য সেখানে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমৈত্বের কথা বলা হয়েছে। যদিও এখানে উল্লেখ না করে পারা যায় না যে, সার্বভৌমত্বের ধারণা পাশ্চাত্যে এক রকম নয়। কোন কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ রকম কথা বলেছেন যে, সার্বভৌমত্বের ধারণার কোন প্রয়োজন নেই। গণতন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থে সার্বভৌমত্বের ধারণাকে তেমন গুরুত্বের সাথে আলোচনাও করা হয় না। তবে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে সার্বভৌমত্ব শব্দটির আপত্তি সম্পর্কে এ সময়ের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী প্রণীত ‘Priorities of The Islamic Movement in the coming Phase’ গ্রন্থের ‘The Movement and the political Freedom and Democracy’ শীর্ষক আলোচনার কিছু অংশ এখানে উদ্বৃত করা প্রয়োজন মনে করছিঃ

The fear of some people here is that democracy makes the people a source of power and even legislation (although legislation is Allah’s alone) should not be heeded here, because we are supposed to be speaking of a people that is Muslim in its majority and has accepted Allah as its Lord, Mohammad as its Prophet and Islam as its Religion. Such a people would not be a expected to pass a legislation that is contestable in Islam and its incontestable principles and conclusive rules. Any way these fears can be over come by one article (in the constitution) that any legislation contradicting the incontestable provisions of Islam be null and void.

কিছু সংখ্যক মানুষের ভয় গণতন্ত্র মানুষকে ক্ষমতার উৎসে পরিণত করে এবং আইন প্রণয়ন করার অধিকার দেয় (যদিও আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর), তার প্রতি কর্ণপাত করা উচিত হবে না। কারণ আমরা এমন এক মানবগোষ্ঠী সম্পর্কে কথা বলছি যারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আল্লাহকে তাদের প্রভু হিসেবে, মুহাম্মদ (সা) -কে তাদের নবী এবং ইসলামকে তাদের ধর্ম হিসেবে মেনে নিয়েছে। আশা করা যায়, এ ধরনের মানুষ এমন আইন প্রণয়ন করবে না, যা ইসলামের অকাট্য নীতি ও সিদ্ধান্তমূলক আইনের পরিপন্থী হবে। যা হোক ইসলামের অলংঘনীয় বিধানের পরিপন্থী যে কোন আইন বাতিল বলে গণ্য করা হবে এমন একটি অনুচ্ছেদ সংবিধানের সংযোজন সংযোজন করে এ আশংকা দূর করা যেতে পারে।
এছাড়া রাজনৈতিক কর্মকান্ডে মানুষ তথা উম্মতের দায়িত্ব সম্পর্কে মহাকবি ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল- এর মতামত হচেছ এরকমঃ

‘ইসলাম গোড়াতেই স্বীকার করে নিয়েছে যে, বাস্তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার ধারক ও বাহক হল উম্মত এবং যেসব কার্যক্রম নির্বাচকমন্ডলী তাদের নেতা নির্বাচনের নিমিত্ত গ্রহণ করে তার অর্থ শুধূ এই যে, তারা তাদের সম্মিলিত ও স্বাধীন নির্বাচন পদ্ধতি দ্বারা উক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতাকে এমন একজন নির্দিষ্ট ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মাঝে ন্যস্ত করে দেয়, যারা তাকে উক্ত ক্ষমতা প্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করে। ইসলামী আইন প্রণয়নের ভিত্তি মিল্লাতের সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতি ও যৌথ মতের উপর প্রতিষ্ঠিত।’ [ইসলামের রাজনৈতিক চিন্তাধারা, লাহোর ১৯১০-১৯১১, ‘মহাকবি ইকবাল’, ড. আবু সাঈদ নূরুদ্দীন, পৃ -২৩৪]

আমরা দেখছি যে, অনেক ইসলামী পন্ডিত গণতন্ত্র শব্দকে শর্তসাপেক্ষে ইসলামের মধ্যে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। ড. আবু সাঈদ নূরুদ্দীন-এর ‘মহাকবি ইকবাল’ গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লামা ইকবাল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিন্তু তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেন যে, গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই। তিনি তার Reconstruction of Religious Thought in Islam-এর ৬ষ্ঠ ভাষণে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে আরও বলেন, ‘ইসলামী রাষ্ট্র স্বাধীনতা, সাম্য, এবং স্থিতিশীলতার চিরন্তন বিধানসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির নীতিমালা শুধু ইসলামের মৌলিক ভাবধারার সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং যেসব শক্তি মুসলিম বিশ্বে কার্যরত রয়েছে তাকেও সুসহংহত করা অপরিহার্য।’ [মহাকবি ইকবাল, ড. আবু সাঈদ নূরুদ্দীন, পৃ-২৩৫]

ইকবালের মতে, গণতন্ত্রের ভিত্তি যদি রূহানী ও নৈতিক হয় তাহলেই তা হবে সর্বোৎকৃষ্ট রাজনৈতিক পদ্ধতি। ইসলামী রাষ্ট্রকে এ কারণেই তিনি “রূহানী গণতন্ত্র” বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইংরেজী সাময়িকী ‘The New Era’ – এর ২৮ জুলাই ১৯১৭ সংখ্যায় তিনি বলেন, ‘ইসলামে গণতন্ত্র অধিকাংশ ইউরোপীয় সমাজসমূহের মতো অর্থনৈতিক সুযোগের সম্প্রসারণ থেকে উৎপন্ন হয়না; বরং এটি একটি রূহানী নীতি, যা ঐ কথার ভিত্তিতে এসেছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই কতকগুলো সুপ্ত শক্তির এমন একটি আধার, যার সম্ভানাসমূহকে এক বিশেষ গুণ ও চরিত্রের দ্বারা উন্নত করা যেতে পারে। ’ [প্রাগুক্ত, পৃ-২৩৯]

অর্থাৎ ইসলাম এমন এক গণতন্ত্র দিয়েছে যা আল্লাহর আইনের অধীন।

অন্যদিকে আমরা দেখি মাওলানা মওদূদী পঞ্চাশ বছর পূর্বে তার “ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ” গ্রন্থে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য Theo-democracy শব্দ দু’টি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তিনি Democracy বা গণতন্ত্র শব্দটি পরিত্যাগ করেননি বরং আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে এটি গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার জীবনের শেষ অধ্যায়ের একটি ব্ক্তব্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

করাচির ‘আখবারে জাহান’ পত্রিকায় ১৯৬৯ সালের ২রা এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইসলাম ও গণতন্ত্র পরস্পর বিরোধী নয়। গণতন্ত্র সেই শাসন ব্যবস্থার নাম, যেখানে জনমতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত, পরিচালিত ও পরিবর্তিত হয়। ইসলামী শাসন ব্যবস্থাও তদ্রুপ। তবে পাশ্চাত্য গণতন্ত্র থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভিন্ন। কেননা পাশ্চাত্য গণতন্ত্র লাগামহীন হয়ে থাকে। জনগণের রায় হলালকে হারাম করে দিতে পারে, যেমন বৃটেনে হয়েছে এবং হচেছ। পক্ষান্তরে ইসলামী গণতন্ত্র কুরআন ও হাদিস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। গোটা জাতি চাইলেও ইসলামের সীমানার ব্ইরে গিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সমাজতন্ত্র এর ঠিক বিপরীত। সমাজতন্ত্র এক জীবন দর্শনের নাম। তার রয়েছে নিজস্ব আকীদা, বিশ্বাস, দর্শন ও নৈতিকতা। ইসলামের সাথে তার কোনোই মিল নেই। [মাওলানা মওদূদীর সাক্ষাৎকার, আধুনিক প্রকাশনী প্রকাশিত, ১ম সংস্করণ, পৃ-২৬৩]

লন্ডনের মাজাল্লাতুন গুরাবা পত্রিকায় ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, যুগের মানুষদের কথা বুঝানোর জন্য আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার কার অপরিহার্য। তবে এগুলো ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কোনো কোনো পরিভাষা বর্জন করা ভালো এবং ওয়াজিব, যেমন সমাজতন্ত্র। আর কোনো কোনোটার ব্যবহার এ শর্তে জায়েজ যে, তার ইসলামী তাৎপর্য ও পাশ্চাত্য তাৎপর্যের পার্থক্য পুরোপুরিভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। যেমন- গণতন্ত্র, সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও সংসদীয় পদ্ধতি। [মাওলানা মওদূদীর সাক্ষাৎকার, আধুনিক প্রকাশনী প্রকাশিত, ১ম সংস্করণ, পৃ-২৫৫]

আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি, পাকিস্তানে যখন বিশ্বের প্রথম ইসলামী সংবিধান রচিত হচ্ছিল তখন তার মধ্যে গণতন্ত্র শব্দটি নেওয়া হয়েছিল আলেমদের সমর্থনে। প্রকৃতপক্ষে একটি আদর্শ প্রস্তাবনা রূপে পাকিস্তানে শাসনতন্ত্রের ভূমিকা আলেমরাই প্রণয়ন করেছিলেন। এ ভূমিকায় গণতন্ত্রের বিষয়টি বলা হয়েছে এভাবেঃ
Wherein the principles of democracy, freedom, equality, tolerance and social justice, as enunciated by Islam, shall be fully observed.

গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সমতা, সহনশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নীতি ইসলামে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, পুরোপুরি সেভাবে মান্য করতে হবে।

অর্থাৎ ইসলাম গণতন্ত্রকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে তা সেভাবে অনুসৃত হবে। এর অর্থ হচ্ছে আলেমগণ, ইসলামী রাজনীতিকগণ শর্তসাপেক্ষে গণত্ন্ত্র শব্দটি, গনতন্ত্র পরিভাষাটি এবং তা দ্বারা যা বোঝায় তা গ্রহন করেছেন। আমরা আগে দেখতে পাই যে, আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী তার Priorities of The Islamic Movement in the Coming Phase, গ্রন্থের একটি আলোচনার শিরোনাম করেছেন, ‘The Movement and Political Freedom and Democracy.’ এতে তিনি দেখিয়েছেন যে, ইসলাম কোন স্বৈরাচার বা রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, Political Freedom-এর মধ্যেই ইসলাম বিকশিত হয়। তিনি দেখিয়েছেন যে, যদিও ইসলাম গণতন্ত্র থেকেও ব্যাপক একটি বিষয়, একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, তথাপি তিনি গণতন্ত্রকে ইসলামের সাথে সংগতিপূর্ণ মনে করেন এবং ইসলামে মানুষের জন্য যে সকল মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা গণতন্ত্রের মাধ্যমেই পূরণ করা সম্ভব। তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে লিখেছেন। তবে যারা ভয় পান যে, গণতন্ত্রের নামে ইসলাম বিরোধী আইন প্রণীত হতে পারে, তাদেরক আশ্বস্ত করার জন্য সংবিধানে ‘কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন পাশ করা যাবে না’ এমন একটি ধারা সংযোজনের তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন,

… …
যা হোক, গণতন্ত্র যে সকল নীতি ও নিশ্চয়তা দান করেছে তা শাসকদের উচ্চাশা ও খেয়ালীপনার উপর একটি নিয়ন্ত্রণ আরোপের নিমিত্তে ইসলাম পৃথিবীতে যে সকল রাজনৈতিক নীতির অবতারণা করেছে তার নিকটতম। এ সকল নীতিসমূহ হচেছ শূরা (consultation), নসিহত (পরামর্শ প্রদান), যা সংগত তার আদেশ দেওয়া, যা খারাপ তা বর্জন করা, অবৈধ আদেশসমূহ অমান্য করা, অবিশ্বাস প্রতিরোধ করা এবং যখনই সম্ভব শিক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবিধান করা। স্বাধীন রাজনৈতিক পরিবেশ এবং গণতন্ত্রেই কেবল সংসদীয় পদ্ধতির বৈধতা ও ক্ষমতা স্বীকৃত এবং জনগণের প্রতিনিধিগণ যে কোন সরকারের উপর সংবিধান লংঘনের অপরাধে অনাস্থা জ্ঞাপন করতে পারে এবং এটি (গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনত) এমন একটি পরিবেশ যেখানে স্বাধীন সংবাদপত্র, নিরপেক্ষ সংসদ, বিরোধী দলের অবস্থান এবং জনসাধারণের মতামত সর্বাপেক্ষা অধিক প্রতিফলিত।

উপরের আলোচনা থেকে লক্ষ্য করা যায় যে, ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুসলিম জনগণ ভোটাধিকার, আইনের শাসন এবং জনগণের নির্বাচিত সরকারই চায়। এসব বোঝাবার জন্যই আজকাল ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। সার্বিক প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ‘গণতন্ত্র’ শব্দ গ্রহণ করার মধ্যে কোন অসুবিধা নেই। পাশ্চাত্যে ইসলাম সম্পর্কে ভুল বোঝবুঝি রয়েছে যে, ইসলাম আগ্রাসী একনায়কত্ববাদী (violent, authoritarian), এর ফলে এসব দূর হবে। মুসলিম বিশ্বেও এর ফলে রাজ-বাদশাহ ও স্বৈরশাসকগণ অন্যায় সুযোগ গ্রহন করতে পারবেনা। আমরা দেখছি যে, বিভিন্ন শাসনতন্ত্রে ব্যবহার ছাড়াও ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইতিমধ্যেই ‘গণতন্ত্র’ পরিভাষাটি গ্রহন করেছেন। এটি সংগত। আমরা আশা করি এ আলোচনা ‘গণতন্ত্র’-এর পরিভাষা সম্পর্কে বিতর্ক দূর করতে সহায়তা করবে।

[লেখাটি ‘গণতন্ত্র ও ইসলাম’ নামে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিইট অব ইসলামিক থ্যট’ প্রকাশিত (২০০৫) সংকলনের ৯২-৯৬ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে].

মুসলিম বিশ্বে ভালবাসা দিবস ও আমরা বাঙ্গালী মুসলমান

ফেব্রুয়ারি 13, 2010

মানি আর নাই মানি। পৃথিবী এখন হাতে মুঠোয় এসেছে দাঁড়িয়েছে। আমরা বিশ্ব সাংস্কৃতি থেকে গা বাঁচিয়ে থাকতে পারব কি? যুগে যুগে রক্ষণশীলরা সে চেষ্টা করতে কম করেন নি। তারপরও কি বাঁধ দিয়ে আটাকাতে পেরেছেন? এটি সম্ভব ও নয়। পানি যেমন ঢালু বেয়ে নেমে যায় কোন বাঁধা সে মানে না। একে বেঁকে একসময় সে তার চলার পথ বের করে নেবে। এই চলার পথে যদি খুব প্রবল প্রাচির তোলে দেওয়া হয় তখন একদিন দেখবেন বার্লিন প্রাচিরের মত ধ্বংস হয়ে যাবে।

ভালবাসা দিবস সৌদী

সারা পৃথিবী জুড়ে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ভ্যালেনটাইন ডে পালন হয়। এই দিবস কেমন করে কিসের জন্য বা কারা এটি শুরু করেছিল তা কেউ খুঁজে দেখেনা। দেখার প্রয়োজনও মনে করেনা। এই দিন আনন্দ করার সূযোগ মেলে তাই সবাই সে আনন্দে শরীক হয়।

ভালবাসা দিবস পাকিস্থান


আমাদের দেশেও ১৯৯২ সাল থেকে এই ভ্যালেনটাইন ডে ভালবাসা দিবস হিসাবে পালন হয়ে আসছে। এখানে শুধু যুবক যুবতিরা নয়, এই ভালবাসায় যে কোন বয়সের যে কোন সম্পর্কের মধ্যে ভালবাসার বিশেষ দিন হিসাবে পালন করা যায়। সে ভালবাসা বাবা মার প্রতি সন্তানের যেমন হতে পারে তেমন সন্তানের প্রতি বাবা মারও হতে পারে। পারে পাড়া প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, বস- কর্মচারীর মধ্যে ভালবাসা।

ভালবাসা দিবস ইন্ডিয়া


বিশেষ করে আনন্দ হাসির বড় দুর্ভিক্ষ আমাদের বাঙ্গালী মুসলমান সমাজে। বাঙ্গালী মুসলমানরা হাসতে জানেনা। আর হাসতে না জানার কারণে আমাদের সমাজ ভালবাসা হীন হয়ে পড়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে আমরা পুরো জাতি মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে যাব। যার পরিনতি ভাল হতে পারেনা। বাঙ্গালী মুসলমানরা বুঝতে চায়না যে ইরান তুরান আরবেও আমাদের মতো মুসলমানরা আছে, তারা কিন্তু আমাদের মতো হাড়ি মুখে বসে থাকেনা। তারা তাদের ভৌগলিক সাংস্কৃতির ঐতিহ্যে প্রাপ্ত উত্সবাদি ও পালন করে থাকে। সেখানে তাদের মসলমানিত্ব খসে পড়েনা।

ভালবাসা দিবস ইরাক

ভালবাসা দিবস বাংলাদেশ


হ্যাঁ এটি অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত ঐ সব উত্সবাদি পালন করতে গিয়ে যাতে বেলাল্লাপনা এবং নৈতিকতা বর্জিত কোন কাজ সংগঠিত না হয়। আমি যেটি বলতে চাচ্ছি যে আজকে সমাজে কোন পর সাংস্কৃতিকে আগ্রাসন ভেবে দমন করার চেষ্টাতে না গিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত। কৌশলী হওয়া উচিত।

ভালবাসা দিবসে ইরান


আমাদের বাঙ্গালী মুসলমানদের কাছে অনেক উদাহরণ আছে যা আমাদের রক্ষণশীলরা দমাতে গিয়ে দমাতে পারেন নাই। যেমন, যাত্রাগান, জারী সারী মারফতি মুর্শিদী গান, সিনেমা নাটক উরুশ মেলায় অংশ নেওয়া থেকে সাধারণ মুসলমানদেরকে আটকে রাখতে পারেন নাই। এবং পারবেনও না। তবে যদি কৌশলী হতেন তবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। যেমন দর্শনকে জবাব দিতে হয় দর্শন দিয়ে ঠিক কালচারকেও জবাব দিতে হয় কালচার দিয়ে।

আমি ভালবাসা দিবসে কতগুলো ছবি দিলাম যে গুলো শুধু আমাদের মুসলিম দুনিয়া থেকে নেওয়া। শুধু আগামী দিনে এই ভালবাসা দিবস কোথায় নিয়ে যাবে সেটি চিন্তা করে দেখবেন। ধন্যবাদ।.

জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

ফেব্রুয়ারি 12, 2010

জ্ঞান অর্জন না করে নিজেকে জানা যায় না, সৃষ্টিতত্ত্ব বোঝা যায় না, আল্লাহকে চেনা যায় না, ক্ষমতাধর হওয়া এবং নেতৃত্বও দেয়া যায় না। ইকরা’ অথাত্ ‘পড়’। ‘পড় তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। এ পড়ার মূল কথা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের সব শাখায় বিচরণ এবং মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জন।

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মুসলমানেরা ছিল সর্বে সর্বা। আল কুরআনের পাশাপাশি তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক সকল প্রকার বই পড়েছেন, গবেষণা করেছেন। তারা মহান আলস্নাহর সৃষ্ট প্রকৃতির নির্দশনাবলীর ওপর গবেষণার মাধ্যমে সত্য উপলব্ধি করেছেন। আত্মশুদ্ধি ঘটিয়েছেন। কুরআন ও অন্য যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই পড়েছেন। হিকমত অর্থাত্ বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।

ইবনে আল হাইসাম ছিলেন সর্বকালের সর্ব শ্র্রেষ্ঠ একজন পদার্থ বিজ্ঞানী। তিনিই সর্বপ্রথম প্রদান করেন জড়তত্ত্ব ও আলোর প্রতিসরণ তত্ত্ব। পরবর্তীতে যা নিউটনের হাতে পুনরাবিষ্কৃত হয়। জাবির বিন হাইয়ান রসায়ন শাস্ত্রের ভিত্তি রচনা করেন। চিকিত্সা বিজ্ঞানে ইবনে সিনা, জাবির হাসান বিন হাইয়ান, আল রাযীর নাম উলেস্নখযোগ্য। তাদের লিখিত বইয়ের ল্যাটিন অনুবাদ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল।

কম্পিউটারের আবিষ্ড়্গার কিন্তু অঙ্ক শাস্ত্রনির্ভর। বস্তুর ‘সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ’ আল খাওয়ারেযমীই প্রথম প্রণয়ন করেছিলেন। নিউটনের বহু আগেই কবি ওমর খৈয়াম ‘বাইনোমিয়াল থিউরাম’ আবিষ্ড়্গার করেন। পৃথিবীর প্রথম সম্পূর্ণ মানচিত্র প্রণয়ন করেন মুসলিম ভূগোলবিদ ইবনে হাক্কল। আল ফারাবি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ও দার্শনিক। তিনি ৭০টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। আল বিরুনি (প্রসিদ্ধ গ্রন্থ কিতাব আল হিন্দ), ইবনে বতুতা প্রমুখ মুসলিম মনীষী ভূবিদ্যার প্রসারে অনেক অবদান রাখেন। ইবনে খালদুনকে বলা হয় ইতিহাস, দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞানের জনক। বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ছিলেন ইবনে জাবির তাবারি। ‘তারিখ আল রাসূল ওয়া আল মুলুক’ তার এ গ্রন্থটি সারাবিশ্বে রেফারেন্স হিসেবে পঠিত হচ্ছে। আল ফিন্দি গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, চিকিত্সা বিজ্ঞানের ৩৬৯টি গ্রন্থ রচনা করেন। অতীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেই নয়; বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কল-কারখানাতেও মুসলমানদের ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

আব্বাসীয় খলিফা মামুন বাগদাদে ‘দারম্নল হিকমাহ’ নামে যে বিজ্ঞান কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন তাতে সে যুগেই প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছিল।


‘The Bible, the Quran and Science’ গ্রন্থে ড• মরিস বুকাইলী উল্লেখ করেন, ‘অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অনেক ঊর্ধে তুলে ধরে। যখন খ্রিষ্টীয় জগতে বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ওপর নিষেধাজ্ঞা চলছিল তখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বহুসংখ্যক গবেষণা ও আবিষ্ড়্গার সাধিত হয়। কর্ডোভার রাজকীয় পাঠাগারে ৪ লাখ বই ছিল। ইবনে রুশদ তখন সেখানে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্য দেশীয় বিজ্ঞানে পাঠদান করতেন। যার কারণে সারা ইউরোপ থেকে পণ্ডিতরা কর্ডোভায় পড়তে যেতেন, যেমন আজকের দুনিয়ায় মানুষ তাদের শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য আমেরিকা যায়।

‘ইসলাম ও আরবি সভ্যতার ইতিহাস’ বইতে ওস্তাভলি বোঁ লিখেছেন, ‘ইউরোপে যখন বই ও পাঠাগারের কোন অস্তিত্ব ছিল না, অনেক মুসলিম দেশে তখন প্রচুর বই ও পাঠাগার ছিল। সত্যিকার অর্থে বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমাহ,য় ৪০ লক্ষ, কায়রোর সুলতানের পাঠাগারে ১০ লক্ষ, সিরিয়ার ত্রিপোলী পাঠাগারে ৩০ লক্ষ বই ছিল। অপরদিকে মুসলমানদের সময়ে কেবল স্পেনেই প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার বই প্রকাশিত হতো। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোতে বইয়ের কদর নেই, বই প্রকাশের বিষয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অপ্রতুল। ইউরোপের একটি ক্ষুদ্র দেশ গ্রিসে বছরে ৫০০টির মতো বই অনুবাদ করে থাকে।

মুসলমানদের অতীত ইতিহাস বই পড়ার ইতিহাস। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। অতীত ইতিহাস থেকে প্রেরণা নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পুনরায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য আজ সারাবিশ্বের মুসলমানদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। কারণ আল কুরআনে বার বার জ্ঞান চর্চার বিষয়ে তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাই মুসলমানদের জন্য জরুরি ধর্মীয় জ্ঞানের সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ ব্যবহারিক জীবনের যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই পড়ার প্রতি উৎসাহিত হওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

০ মোশারেফ হোসেন পাটওয়ারী ০.

চরমপন্থার লক্ষণ : ড।শেখ ইউসূফ আল কারযাভী

ফেব্রুয়ারি 11, 2010

চরমপন্থার লক্ষণ চরমপন্থার প্রথম লক্ষণ হচ্ছে অন্ধতা। চরমপন্থী বা গোঁড়া ব্যক্তি নিজের মতের প্রতি একগুঁয়ে ও অসহিষ্ণুর মতো এমন অটল থাকে যে, কোনো যুক্তিই তাকে টলাতে পারে না।অন্য মানুষের স্বার্থ, আইনের উদ্দেশ্য ও যুগের অবস্থা সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা থাকে না। তারা অন্যের সাথে আলোচনায়ও রাজী হয় না যাতে তাদের মতামত অন্যের মতামতের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা যায়। তাদের বিবেচনায় যা ভাল হয় কেবল তা অনুসরণেই তারা প্রবৃত্ত হয়। যারা অন্যের মতামত দাবিয়ে রাখা ও উপেক্ষা করার চেষ্টা চালায় এবং যারা এর জন্য তাদেরকে অভিযুক্ত করে, আমরা উভয়কেই সমভাবে নিন্দা করি।বস্তুতপক্ষে যারা নিজেদের মতকেই কেবল নির্ভেজাল বিশুদ্ধ এবং অন্যদেরকে ভ্রান্ত বলে মনে করে তাদেরকে কঠোরভাবে নিন্দা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই বিশেষ করে তখন, যখন তারা কেবল ভিন্নমতের জন্যে প্রতিপক্ষকে জাহিল, স্বার্থন্বেষী, অবাধ্য তথা ফিসকের অভিযোগে অভিযুক্ত করে।তাদের আচরণে মনে হবে যেন তারাই নির্ভেজাল, খাঁটি বিশুদ্ধ এবং তাদের প্রতিটি কথাই যেন ওহী বা এলহাম! এ ধরণের একগুঁয়ে দৃষ্টিভঙ্গি উম্মাহর ইজমার পরিপন্থী।কেবলমাত্র কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য যে কোনো ব্যক্তির যে কোনো মত গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে। এটাই উম্মাহর সর্ববাদী সম্মত রায়।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কিছু লোক বিভিন্ন জটিল বিষয়ে নিজেদের ইজতিহাদের অধিকার প্রয়োগ করে খেয়ালখুশী মতো রায় দিয়ে থাকেন।কিন্তু সমকালীন বিশেষজ্ঞ আলিমদেরকে একক বা যৌথভাবে ইজতিহাদের অধিকার প্রয়োগ করতে দেখলে তারা বেজায় নাখোশ হন। অথচ ঐ সব ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহর এমন হাস্যকর ব্যাখ্যা দেন যা আমাদের পূর্বপুরুষ বুজুর্গানে দ্বীন এবং সমসাময়িক আলিমদের রায় বা সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা নিজেদেরকে হযরত আবু বকর, উমর, আলী ও ইবনে আব্বাসের (রা) সমপর্যায়ের মনে করেন। তাদের এই উদ্ভট দাবীতে তেমন ক্ষতি ছিল না যদি তারা তাদেরকে কেবল সমসাময়িক পন্ডিতদের সমপর্যায়ের মনে করতেন।

সুতরাং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, চরমপন্থা বা গোঁড়ামির পরিস্কার লক্ষণ হচ্ছে অন্ধতা। তার দাবীর সারকথা: “বলার অধিকার কেবল আমার, তুমি কেবল শুনবে। আমি পথ দেখাবো, তুমি সেই পথে চলবে। আমার মত অভ্রান্ত, তুমি ভ্রান্ত। আমার ভুল হতে পারে না, আর তোমারটা কখনো ঠিক হতেই পারে না।”অর্থাৎ একজন তার অন্ধমতানুযায়ী কোনোভাবে অন্যের সাথে সমঝোতায় আসতে পারে না। অথচ আমরা জানি, সমঝোতা ছাড়া সমাজ সংহত হতে পারে না। সমঝোতা কেবল তখনই সম্ভব যখন কেউ মধ্যপন্থায় অবস্থান নেয়। কিন্তু একজন চরমপন্থী মধ্যপন্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, বিশ্বাস তো দূরের কথা। জনগণের সংগে তার সম্পর্ক পূর্ব ও পশ্চিমের সম্পর্কের মতো- যতই তুমি একটির নিকটে যাবে তুমি অন্যটি হতে দূরে সরে যাবে। বিষয়টি আরো জটিল হয়ে যায় যখন এ রকম ব্যক্তি অন্যকে বাধ্য করার মনোভাব গ্রহণ করে কেবল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, অনেক সময় অভিযোগের মাধ্যমে যে প্রতিপক্ষ অবিশ্বাসী, বিপথগামী কিংবা বেদাতী। এরূপ বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাস শারীরিক সন্ত্রাসের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
চরমপন্থার দ্বিতীয় পরিচয় হচ্ছে, সর্বক্ষণ বাড়াবাড়ি করার নীতিতে অটল থাকা এবং সমঝোতার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও অন্যকে তার মতো আচরণে বাধ্য করতে প্রয়াসী হওয়া যদিও তার কাজটি আল্লাহর বিধানসম্মত নয়। তাকওয়া ও সতর্কতার কারণেও এক ব্যক্তি ইচ্ছা করলে কোনো কোনো বিষয়ে কখনো কখনো কঠোর মত পোষণ করতে পারে। কিন্তু এটা এমন অভ্যাসে পরিণত হওয়া উচিত নয় যাতে সে যেখানে প্রয়োজন এমন ক্ষেত্রেও সহজ সরল বিষয়গুলো পরিহার করে। এরুপ দৃষ্টিভঙ্গি কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তা চান, যা তোমাদের জন্যে ক্লেশকর তা চান না।” (২:১৮৫)

আল্লাহ রাসূলও (সা.) ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হাদীসে বলেছেন: “(ধর্মীয় বিষয়গুলো) সহজ করে তুলে ধরো কঠিন করো না।” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত)

তিনি আরো বলেছেন : “তাঁর প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করলে আল্লাহ খুশী হন যেমন (লোকেরা) তাঁর অবাধ্য হলে তিনি নারাজ হন।” (আহমাদ, বায়হাকী ও তাবারী) এছাড়া রেওয়ায়েত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কে যখনি দু’টি কাজের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়েছে, গর্হিত না হলে তিনি সহজতম পথটিই সর্বদা বেছে নিয়েছেন।” (বুখারী ও তিরমিযী)

মানুষের জন্যে কোনো কাজকে জটিল করে তোলা কিংবা তার ওপরে চাপ সৃষ্টি করা রাসূলুল্লাহ (সা) -এর উজ্জ্বলতম গুণাবলীর পরিপন্থী। এটি পূর্ববর্তী বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং পরবর্তীকালে কুরআনুল কারীমেও উল্লেখ করা হয়েছে: “যিনি তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু বৈধ ও উত্তম (পবিত্র) এবং অপবিত্র বস্তু অবৈধ করেন এবং মুক্ত করেন তাদেরকে তাদের গুরুভার হতে ও শৃংখল হতে যা তাদের ওপর ছিল।” (৭:১৫৭)

এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সা) কেবল একাকী নামযকে দীর্ঘ করতেন। আসলে তিনি পা ফুলে না ওঠা পর্যন্ত সারা রাত ধরে নামায পড়তেন। কিন্তু যখন তিনি জামায়াতে ইমামতি করতেন তখন তাঁর অনুসারীদের সহ্য ক্ষমতা ও পরিস্থিতির বিচারে নামায সংক্ষিপ্ত করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যখন তোমাদের মধ্যে কেউ নামাযের ইমামতি করে তখন তা সংক্ষিপ্ত করা উচিত, কেননা সেখানে দুর্বল, রুগ্ন ও বৃদ্ধলোক থাকে; কিন্তু কেউ একাকী নামায পড়লে ইচ্ছা মতো দীর্ঘ করতে পারো।” (বুখারী)

আবু মাসুদ আল আনসারী বর্ণনা করেছেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলল, “হে আল্লাহর রাসূল, আমি সালাতুল ফজরে হাযির হই না, কেননা অমুক অমুক নামাযকে দীর্ঘ করে থাকে। ” রাসূলুল্লাহ (সা) অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “হে মানুষেরা তোমরা মানুষকে উত্তম কাজের (নামায) প্রতি বিতৃষ্ণ করতে চাও? যখন কেউ নামায পড়াবে তখন তা সংক্ষিপ্ত করবে, কেননা সেখানে দুর্বল, বৃদ্ধ ও ব্যস্ত লোক থকে। ” আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, রাসূলুল্লাহ (সা) একইভাবে রাগন্বিত হয়েছিলেন যখন জানতে পারেন যে, মুয়ায (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “যখন আমি নামাযের জন্যে দাঁড়াই তখন আমি একে দীর্ঘ করার ইচ্ছা করি, কিন্তু শিশুর কান্না শুনে আমি নামায সংক্ষিপ্ত করি, কারণ আমি মাতাদের কষ্টে ফেলতে চাই না।”

অবশ্য করণীয় কাজগুলোর মতো ঐচ্ছিক কাজগুলো সম্পন্ন করার চাপ দেয়াটাও বাড়াবাড়ির শামিল। অনেক সময় মাকরুহাতের জন্যে এমনভাবে কৈফিয়ত তলব করা হয় যেন এগুলো মুহাররামাতের (হারাম সমূহের) অন্তর্ভূক্ত। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ যেসব কর্তব্য কর্মের সুষ্পষ্ট আদেশ দিয়েছেন কেবল সেসব ব্যাপারেই কৈফিয়ত তলব করা যায়। এর বাইরে অতিরিক্ত সকল ধরনের ইবাদতই ঐচ্ছিক। নিম্নোক্ত ঘটনাটি থেকে বোঝা যাবে এটাই রাসূলুল্লাহ্ (সা) -এর মত: একদা এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (সা) কে অবশ্য পালনীয় কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি মাত্র তিনটি কাজের কথা উল্লেখ করলেন- নামায, যাকাত ও রোযা। এছাড়া আর কিছু করার আছে কিনা জিজ্ঞাসিত হয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) না-বাচক জবাব দিলেন এবং বললেন যে, বেদুঈন ইচ্ছে করলে বেশী কিছুও করতে পারে। বেদুঈন বিদায় নেয়ার আগে প্রতিজ্ঞা করলো, রাসূলুল্লাহ (সা) যা কিছু বলেছেন তার চেয়ে বেশীও করবে না, কমও করবে না। মহানবী (সা) একথা শুনে বললেন, “যদি সে সত্য কথা বলে থাকে তবে সে সফল হবে, অথবা বলেছিলেন “তাকে জান্নাত মঞ্জুর করা হবে।” (বুখারী)

আজকের যুগে একজন মুসলমান যদি অবশ্য কর্তব্য কাজগুলো সম্পন্ন করে এবং মুহাররামাতের সবচেয়ে জঘন্য কাজ থেকে দূরে থাকে তবে তাকে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য করা যায় যতক্ষণ পর্যন্ত সে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখে। এমনকি যদি সে ছোটখাটো মুহাররামাতের কাজ করে ফেলে তবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের নামায, জুমা’র নামায ও রোযার বদৌলতে তার ছোট অন্যায়গুলোর কাফফারাহ হয়ে যাবে। কেননা কুরআন ঘোষণা করছে: “ভাল কাজ খারাপ কাজকে অবশ্যই মিটিয়ে দেয়।” (১১:১১৪)

আরেকটি আয়াতে আছে: “যদি তোমরা সবচেয়ে জঘন্য নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকো তবে আমরা তোমাদের সকল খারাপ কাজকে মুছে ফেলবো এবং তোমাদেরকে উচ্চ সম্মানের স্থানে আসীন করবো।” (৪:৩১)

একজন মুসলমান যদি কিছু বিতর্কমূলক বিষয় অনুসরণ করেন যার হালাল বা হারাম হওয়া সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই অথবা এমন কিছু কাজ পরিত্যাগ করেন যার ওয়াজিব হওয়া বা মুবাহ হওয়া অনিশ্চিত, তাহলে কুরআন ও সুন্নাহর উপরিউক্ত প্রমাণের প্রেক্ষিতে তাকে কি আমরা ইসলাম বহির্ভূত বলে ঘোষণা করতে পারি: আর এ কারণেই আমি কিছু সাধু লোকের কঠোর মতের বিরোধী। তারা শুধু নিজেদের আচরণের মধ্যেই এই গোঁড়ামি সীমাবদ্ধ রাখেন না, অন্যকেও এতে অহেতুক প্রভাবিত করতে চান। আরো আপত্তি আছে। এসব লোক কোনো কোনো আলিমের বিরুদ্ধেও বিশেদগার করতে কুন্ঠিত হন না। অথচ এসব আলিম সত্যিকার অর্থে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সাধারণ মানুষের ওপর অনর্থক চাপিয়ে দেয়া বিধি-নিষেধের বোঝা হালকা করতে চান।

চরমপন্থার আরেকটি লক্ষন হচ্ছে নির্দয় কঠোরতা। চরমপন্থীদের স্থানকালের বিবেচনা জ্ঞান নেই। নও-মুসলিমদের প্রতি অন্তত প্রাথমিক অবস্থায় নম্র আচরণ করা উচিত-সেই নও-মুসলিম মুসলিম অথবা অমুসলিম যে দেশেরই হোক। এমনকি ধর্মের প্রতি সদ্য অনুরক্ত মুসলমানদের প্রতিও সহৃদয় দৃষ্টি দেয়া দরকার। নব দীক্ষিত মুসলমানদের প্রথমেই ছোটখাট বিষয়গুলো মানতে বাধ্য করানো উচিত নয়। প্রথমে তাদেরকে মৌলিক বিষয়গুলো বোঝার সুযোগ দিতে হবে। তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তাধারা ইসলামের আলোকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। একবার তাদের মনে ঈমানের চেতনা বদ্ধমূল হয়ে গেলেই ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ এবং ক্রমান্বয়ে বাস্তব জীবনে আল্লাহর বিধি বিধান রূপায়ণের তাগিদ সৃষ্টি করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন থেকে আমরা এর সত্যতা খুঁজে পাই। হযরত মুয়ায (রা) কে ইয়ামেনে পাঠানোর সময় হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছিলেন, “তুমি আহলে কিতাবের একটি জনগোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছ। সেখানে পৌঁছে তাদেরকে এই সাক্ষ্য দিতে বলবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর প্রেরিত রাসূল। যদি তারা এটা মেনে নেয় তখন তাদেরকে বলবে যে, আল্লাহ দিনে রাতে পাঁচ বার নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তারপর বলবে যে, আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে গরীবদের মধ্যে বন্টনের আদেশ দিয়েছেন। …….. (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত)

মুয়ায (রা)- এর প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা)-এর উপদেশের মধ্যে দাওয়াতী কাজের ক্রমিক পদ্ধতি লক্ষণীয়। উত্তর আমেরিকা সফরের সময় আমি কিছু নিষ্ঠাবান মুসলিম তরুণের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। এই তরুণরা একটি মুসলিম গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট। সেখানে মুসলমানরা সাধারণত শনি ও রবিবারের ভাষণের সময় চেয়ারে বসতো। ঐ তরুণরা মনে করে মাদুরে কেবলামুখী হয়ে বসা উচিত। এছাড়া শার্ট প্যান্টের পরিবর্তে ঢিলেঢালা পোষাক পরিধান এবং ডাইনিং টেবিলের পরিবর্তে মেঝেতে বসে খাওয়া উচিত। বিষয়টির ওপর তরুণেরা বিতর্কের ঝড় তুলেছিলো। উত্তর আমেরিকার মতো জায়গায় এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ দেখে আমি ক্ষুব্ধ না হয়ে পারিনি। সুতরাং আমি আমার ভাষণে বললাম : এই বস্তুবাদী সমাজে আপনাদের প্রধান কাজে হওয়া উচিত তাওতীদ ও আল্লাহর বন্দেগীর দিকে মানুষকে আহবান করা এবং পরকাল ও মহান ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করা। সেই সাথে বৈষয়িক উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেও এই দেশগুলো যে জঘন্য ক্রিয়াকলাপে নিমজ্জিত তার পরিণতি সম্পর্কেও তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে হবে। ধর্মীয় আচার-আচরণ ও খুঁটিনাটি বিষয়ে পদ্ধতিগত উৎকর্ষ অর্জনের বিষয়টি স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে বিচার করা উচিত। এর আগে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, ধর্মের মৌলিক ও অত্যাবশ্যক নীতিমালা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আরেকটি ইসলামী কেন্দ্রের ঘটনা উল্লেখ করছি। মসজিদে ঐতিহাসিক ও শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে সেখানে বেশ হৈ চৈ হচ্ছিল। প্রদর্শনীর বিরোধীরা অভিযোগ করছেন যে, মসজিদকে সিনেমা হলে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু তারা একথা বেমালুম ভুলে বসেছেন যে, মসজিদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রের কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল হিসেবে এক ব্যবহার করা। হযরত মুহাম্মদ (সা) -এর আমলে মসজিদ ছিলো একাধারে দাওয়া, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কার্যক্রমের সদর দফতর। এটা সম্ভবত সকলেরই জানার কথা, আবিসিনিয়া থেকে আগত একদল লোককে রাসূলুল্লাহ (সা) মসজিদের মধ্যস্থলে বশা দিয়ে ক্রিয়া প্রদর্শনের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং হযরত আয়েশা (রা) তা দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। (বুখারী এবং অন্যান্য)

গোঁড়ামির চতুর্থ লক্ষণ হচ্ছে, মানুষের প্রতি আচার-আচরণে অশিষ্টতা, উপস্থাপনায় স্থুলতা এবং দাওয়াতী কাজে গোবেচারা ভাব। এসবই হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার সাথে সঙ্গতিহীন। আল্লাহ তায়ালা কুশলী ও মধুর ভাষায় ইসলামের প্রতি মানুষকে আহবান করার আদেশ দিয়েছেন: “হিকমতের সাথে ও সদুপদেশ দ্বারা তোমার প্রভুর দিকে (মানুষকে) আহবান জানাও এবং সদ্ভাবে (উৎকৃষ্টতম ও সুবিবেচনা প্রসূত পন্থায়) তাদের সাথে আলোচনা করো।”(১৬:১২৫)

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রসঙ্গ টেনে কুরআন বলছে: “এখন তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্যে বেদনাদায়ক, তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, ঈমানদারদের প্রতি তিনি দয়াময় ও করুণাশীল।” (৯:১২৮।

আল কুরআনুল কারীমে সাহাবীদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্পর্কের রূপ বর্ণনা করে বলা হয়েছে: “আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন, আপনি যদি কর্কশ ও কঠোর হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে সরে পড়তো।” (৩:১৫৯)

আল কুরআনে মাত্র দুটি ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও কঠোরতার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, যুদ্ধেক্ষেত্রে। যুদ্ধ বিজয় অর্জনের লক্ষ্য দৃঢ়তা ও কঠোরতার অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে কোমলতা পরিহার করতে হবে অন্তত যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। কুরআন বলছে, “সেসব অবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও, তারা তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখুক।” (৯:১২৩)

দ্বিতীয়ত, শরীয়তের বিধান অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি কার্যকর করার ব্যাপারে। সেক্ষেত্রে আল্লাহর আইন প্রয়োগের বেলায় নমনীয়তার কোনো অবকাশ নেই। কুরআনের ভাষায়: “ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী তাদের প্রত্যেককে এক শত বেত মারো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবাম্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামতে বিশ্বাসী হও। ” (২৪:২)

কিন্তু দাওয়াতী কাজের ব্যাপারে সহিংসতা ও কঠোরতার কোনো অবকাশ নেই। এই হাদীসে তার প্রমাণ পাওয়া যায়: “আল্লাহ সকল ব্যাপারে দয়া পছন্দ করেন এবং দয়া সবকিছু সুন্দর করে, সহিংসতা সবকিছু ত্রুটিপূর্ণ করে।” এছাড়া আমাদের বুজর্গ পূর্বপুরুষরাও একথা বলেছেন, “যারা ভাল কাজের আদেশ দিতে চায় তারা যেন তা নম্রতার সাথে করে। ” সহিংসতা আল্লাহর পথে দাওয়াতী কাজের উদ্দেশ্যকেই পন্ড করে দেয়। দাওয়াতী কাজের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের হৃদয় কন্দরে আলোর রশ্মিপাত করা, যে আলোর পরশে তার ধ্যান-ধারণা, চিন্তাধারা, আবেগ-আচরণ রূপান্তরিত হয়ে তাকে একটা নতুন সত্তা হিসেবে সৃজন করবে। সে আল্লাহ্ দ্রোহী থেকে পরিণত হবে একজন আল্লাহ ভিরু ব্যক্তিত্বে। দাওয়াতী কাজ একইভাবে সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও পদ্ধতির ভিত্তিমূলে নাড়া দিয়ে তাকে নতুনরূপে গড়তে চায়।

এসব মহান উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে প্রজ্ঞা ও সহৃদয়তা অত্যাবশ্যক। তদুপরি প্রয়োজনে মানুষের প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রাখা। মানব প্রকৃতিতে একগুঁয়েমি, পরিবর্তন বিরোধিতা ও তর্কপ্রিয়তা অন্তর্নিহিত। দাওয়াতী কাজের সময় এই প্রকৃতির মোকাবিলা করার একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে নম্র, কোমল ও কৌশলময় আচরণ। এই হাতিয়ার ব্যবহার করেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তির হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে হবে।ফলত তার প্রকৃতি যতোই অনমনীয় হোক এক সময় তাকে নমনীয় হতেই হবে। তার অহঙ্কার-অহমিকা অমায়িকতায় রূপান্তরিত হবেই। আলকুরআন আমাদেরকে এই প্রক্রিয়া অবলম্বেনের দিকেই নজর দিতে বলেছে। এছাড়া পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ ও তাঁদের উম্মতরা একই প্রক্রিয়ায় দাওয়াতী কাজ চালিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁর পিতা ও জনগণের প্রতি, শুয়াইব(আ) তাঁর জনগোষ্ঠীর প্রতি, হযরত মূসা (আ) ফেরাউনের প্রতি তথা সূরা ইয়াসিনে (৩৬:২০) উল্লিখিত সাধারণ মানুষের প্রতি ঈমানদারদের দাওয়াতী কাজ একই পন্থায় সম্পন্ন হয়েছে। আর সব দাওয়াতী কাজের মূল কথা ছিলো একটি: তোমরা আল্লাহর বন্দেগী কবুল করো। একজন ঈমানদার যখন তার সমগোত্রীয়দের আল্লাহর পথে দাওয়াত দেন তখন তার মধ্যে সমমর্মিতার আকুল আবেগ প্রতিধ্বনিত হয়। ফেরাউনের প্রতি একজন ঈমানদারের দাওয়াতের মধ্যেও সেই ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে: “হে আমার স্বজাতি! আজ তোমাদেরই কর্তৃত্ব, দেশে তোমরাই প্রবল; কিন্তু আল্লাহর আযাব যখন আমাদের ওপর আপতিত হবে তখন আমাদেরকে কে সাহায্য করবে? (৪০:২৯)

অতঃপর তিনি আল্লাহর বাণীর প্রতি কর্ণপাত না করার পরিণামে অতীতের জাতিসমূহকে কিভাবে আযাব ভোগ করতে হয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন: “হে আমার স্বজাতি! আমি তোমাদের জন্যে পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের শাস্তির দিনের অনুরুপ দুর্দিনের আশঙ্কা করি যেমন ঘটেছিলো নূহ, আদ, সামূদ ও তাদের পূর্ববর্তীদের ক্ষেত্রে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর কোন অবিচার করতে চান না।” (৪০: ৩০-৩১)

এর পর তিনি কেয়ামত দিবসের ভয়াবহতা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে বলছেন–

“হে আমার স্বজাতি! আমি তোমাদের জন্যে সেই কিয়ামত দিবসের ভয় করছি যেদিন তোমরা পরস্পরকে ডাকবে (এবং বিলাপ করবে); কিন্তু সেদিন তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাতে থাকবে। আল্লাহর তরফ থেকে সেদিন তোমাদেরকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার জন্যে কোন পথপ্রদর্শক নেই।” (৪০:৩২-৩৩)

এভাবে আমরা দেখি একজন নবী মিনতি সহকারে নম্র ও কোমল ভাষায় দাওয়াত দিয়ে চলেছেন যার মধ্যে হুঁশিয়ারি আছে, আশার প্রেরণাও আছে:

“হে আমার কওম! আমাকে অনুসরণ করো। আমি তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবো। ইহকালীন জীবন (অস্থায়ী) উপভোগের বস্তু এবং একমাত্র পরকালীন আবাসই স্থায়ী- এবং হে আমার কওম! কী আশ্চর্য! আমি তোমাদেরকে মুক্তির দিকে আহবান করছি আর তোমরা আমাকে জাহান্নামের দিকে ডাকছ! তোমরা আমাকে বলছ আল্লাহকে অস্বীকার করতে এবং তাঁর সাথে শিরক করতে যার সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান নেই; আর আমি তোমাদেরকে সেই সর্বশক্তিমানের দিকে আহবান করছি যিনি ক্ষমাশীল।” (৪০: ৩৮-৪২)

অতঃপর তিনি উপদেশ বাণী দিয়ে শেষ করছেন: “(এখন) আমি যা বলছি অচিরেই তা তোমরা স্মরণ করবে। আমি (আমার) যাবতীয় বিষয় আল্লাহতে অর্পণ করছি; আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর সর্বদা দৃষ্টি রাখেন।” (৪০:৪৪)

বস্তুত এই পদ্ধতিই সমকালীন ইসলামী কর্মীদের দাওয়াতী কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত যাতে তারা একগুঁয়ে ও অন্য ধর্মের লোকদের প্রতিকূল প্রকৃতির সাথে মুকাবিলা করতে পারে। ফেরাউনের কাছে প্রেরণের সময় মূসা ও হারুন (আ)-এর প্রতি আল্লাহ যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাতেও একই সুর ধ্বনিত : “তোমরা দ’জনেই ফেরাউনের কাছে যাও। কেননা সে সকল সীমা লংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবে সম্ভবত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে (আল্লাহকে)।” (২০: ৪৩-৪৪)

অতএব হযরত মূসা (আ) ভদ্রভাবে ফেরাউনকে সম্বোধন করে বললেন, “তোমার কি আগ্রহ আছে যে, তুমি পবিত্র হও এবং আমি তোমাকে তোমার প্রভুর পথে পরিচালিত করি যাতে তুমি তাঁকে ভয় করো।” (৭৯: ১৮-১৯)

এই দৃষ্টিতে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, দাওয়াতী কাজে অভিজ্ঞ লোকেরা ভিন্নমতাদর্শী লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনার সময় কোনো কোনো তরুণের অসহিষ্ণু আচরণকে সুনজরে দেখেন না। মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার সময়ে এরা প্রায়ই কর্কশ ও ক্ষিপ্ত আচরণ করে থাকে। ছোট-বড়, মাতা-পিতা, শিক্ষক, অভিজ্ঞ বুযুর্গ প্রমুখের সাথে কথা বলা বা আচরণের ব্যাপারে তাদের মান মর্যাদার দিকেও খেয়াল করা হয় না। মেহনতি মানুষ নিরক্ষর ও বিভ্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক ও আচরণে তেমন তারতম্য দেখা যায় না। আবার রয়েছে এমন সব ব্যক্তি যারা শুধু বিদ্বেষবশত ইসলামের বিরোধিতা করে জ্ঞানের অভাবে। মোটকথা সকল শ্রেণীর লোককে তাদের নিজস্ব অবস্থানের দিকে লক্ষ্য রেখে সুযোগ ও সুবিধা মতো দাওয়াত দিতে হবে। কিন্তু আমদের সমাজে এখন এরুপ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লোকের বড়ই অভাব। প্রাথমিক যুগের হাদীস বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে এ দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেসব রাবী নিজের রেওয়ায়েত নিয়ে আত্মপ্রচারে নেমে পড়তেন তাদের রেওয়ায়েত মুহাদ্দিসরা গ্রহণ করেননি। বরং তাদেরটাই গ্রহণ করেছেন যারা নিজেদের উদ্ভাবন সম্পর্কে ছিলেন প্রচারভিমুখ। সন্দেহ ও অবিশ্বাসও গোঁড়ামির একটি লক্ষণ। চরমপন্থীরা তাৎকষণিকভাবে একজনকে অভিযুক্ত করে বসে এবং সঙ্গে সঙ্গে রায় দিতেও তারা পারঙ্গম! “দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একজন নির্দোষ”-এ প্রবাদটির তারা থোড়াই পরোয়া করে। তারা সন্দেহ করা মাত্র একজনকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলে, ব্যাখ্যা ছাড়াই উপসংহারে উপনীত হয়। তাদের দৃষ্টিতে কারো সামন্য ত্রুটি যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার শামিল! সোজা কথা, ভুলেই পাপ, পাপেই কুফরী! এ ধরণের প্রতিক্রিয়া ইসলামের শিক্ষার চরম লংঘন ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ ইসলাম চায় এক মুসলমান আরেক মুসলমানের আয়না হয়ে পরস্পরকে সংশোধন করুক; বিনম্র ও ক্ষমাশীল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অন্যের আচরণ ও জীবন যাত্রায় উৎকর্ষতা আনুক।

কেউ যদি ঐসব চরমপন্থীদের সাতে দ্বিমত পোষণ করে, তবে তার ধর্ম বিশ্বাস ও চরিত্রের সাধুতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তার মত ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক হলেও তাকে সীমালংঘনকারী বিদয়াতী, এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহর অমর্যাদাকারী বলেও চিহ্নিত করা হয়। এপ্রসঙ্গে অনেক নজীর উল্লেখ করা যায়। আপনি যদি বলেন লাঠি বহন করা বা মেঝেয় বসে খাওয়ার সাতে সুন্নাহর কোনো সম্পর্ক নেই তাহলে আপনাকে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অমর্যাদাকারী বলতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হবে না। অভিজ্ঞ মুসলিম মনীষী ও আলিমরাও এ অভিযোগ থেকে রেহাই পান না। কোনো ফকীহ যদি মুসলমানদের সুবিধা হতে পারে এমন কোনো ফতোয়া দেন তবে তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় ব্যাপারে শৈথিল্যের অভিযোগ আনা হবে। যদি কোনো মুবাল্লিক যুগোপযোগী পদ্ধতিতে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন তবে তাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার ভক্ত বলে অপবাদ দেয়া হবে। শুধু জীবিত নয়, মৃত ব্যক্তিরাও অভিযোগের হাত থেকে রেহাই পান না। অর্থাৎ চরমপন্থীদের সাথে দ্বিমত পোষণ করলেই আর রক্ষা নেই। নির্বিচারে তাকে ফ্রিম্যাসন, জাহমী অথবা মুতাযিলী বলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। এখানেই শেষ নয়, ইসলামের চার মহান ফকীহর বিরুদ্ধেও চরমপন্থীরা নির্দ্বিধায় বিষেদগার করতে কসুর করেনি।

প্রকৃতপক্ষে হিজরী চতুর্থ শতকের মুসলিম উম্মাহর সমগ্র ইতিহাসকে আক্রমনের লক্ষ্য বস্তু করা হয়। অথচ এ কালটা নজীরবিহীন সভ্যতা ও গৌরভময় অবদানের জন্যে অবিস্মরণীয়। চরমপন্থীরা এই যুগটাকে সমসাময়িক সকল অশুভ কর্মকান্ডের উৎসস্থল বলে মনে করে। কেউ কেউ এটাকে ব্যক্তিগত ক্ষমতা দ্বন্ধ সংঘাতের যুগ বলে বিশ্বাস করে। আবার কেউ বলে এটা অজ্ঞাত ও কুফরীর যুগ। এই ধ্বংসাত্মক প্রবনতা নতুন কিছু নয়। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যামানায়ও চরমপন্থীদের অস্তিত্ব ছিল। একদা জনৈক চরমপন্থী আনসার গনিমতের মাল বণ্টনে রাসূলল্লাহ (সা)-এর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলো। আধুনিক চরমপন্থীদের মারত্মক দোষ হলো সংশয়। তারা যদি কুরআন ও সুন্নাহকে সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতো তাহলে দেখতো যে, মুসলমানদের অন্তরে পারস্পারিক বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করাই ইসলামের লক্ষ্যে। কোনো মুসলামানের উচিত নয় আরেক মুসলমানের গুণগুলো উপেক্ষা করে তার ছোট-খাট ত্রুটিগুলো বড় করে দেখা। কুরআন বলছে: “অতএব, আত্মপ্রশংসা করো না। তিনিই সবচেয়ে ভাল জানেন কে পরহেযগার।” (৫৩:৩২)

বস্তুত ইসলাম দুটি বিষয়ে মানুষকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে: আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং অপরকে সন্দেহ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! বহুবিধ অনুমান থেকে দূরে থাকো, কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ।” (৪৯:১২)

রাসূলূল্লাহ (সা) এ প্রসঙ্গে বলেন, “সংশয় থেকে দূরে থাকো, কেননা সংশয় হচ্ছে কোনো কথাবার্তার মিথ্যা দিক।” (সকল প্রমাণ্য সূত্রে সমর্থিত)

ঔদ্ধত্য, অন্যকে ঠকানোর মনোবৃত্তি ও ঘৃণা থেকেই সংশয়ের উৎপত্তি। এগুলো হচেছ অবাধ্য আচরণের প্রথম ভিত্তি আর অবাধ্যতা হচ্ছে শয়তানী কাজ। শয়তান এই দাবী করেছিলো, “আমি তাঁর (আদমের) চেয়ে ভাল।” (৩৮:৭৬)

আর এজন্য সে হযরত আদম (আ) কে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো। এ ধরণের অহঙ্কারের পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারী পাওয়া যায় এই হাদীসে:“তুমি যদি শোন যে, কেউ বলছে মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে তাহলে বৃথা দম্ভের জন্যে সে নিজেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।” (মুসলিম)

আরেকটি রেওয়াতে আছে : “….. সে নিজেই তাদের ধ্বংসের কারণ।” অর্থাৎ তাঁর সন্দেহ ও অহঙ্কার এবং আল্লাহর রহমত থেকে তাদেরকে নিরাশ করানোই (ধ্বংসের কারন) এমন একটি প্রবণতা যা অবয়ের সূচনা করে এবং মুসলিম মনীষীরা একে “মনের রোগ” বলে চিহ্নিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ(সা) ও এ ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন, “তিনটি মারাত্মক পাপ আছে- অতিরিক্ত লোভ, কামনা ও অহঙ্কার।” মুসলমান তার কোনো কাজেই অহঙ্কার করতে পারে না। কেননা সে তো এ ব্যাপারে কখনোই নিশ্চিত হতে পারে না যে, আল্লাহ তার আমল মঞ্জুর করবেন। আল্লাহ দাতা ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলকুরআনে বলেছেন: “এসব লোক ভীতিপূর্ণ হৃদয়ে দান-খয়রাত করে। কারণ তারা তাদের প্রভুর কাছে ফিরে যাবে।” (২৩:৬০)

হাদীস শাস্ত্রে কুরআনের এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে এরা হচ্ছে সেই সব সৎকর্মশীল লোক যারা এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে যে, তাদের আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। ইবনে আতা বলেন: “আল্লাহ তোমার জন্যে আনুগত্যের দুয়ার খুলে দিতে পারেন। কিন্তু গ্রহনযোগ্যতার দ্বার নাও খুলতে পারেন। তিনি তোমাকে অবাধ্য হওয়ার পরিস্থিতির মধ্যে ফেলতে পারেন (যাতে তুমি অনুতপ্ত হয়ে) আবার সঠিক পথে ফিরে আসতে পারো। অবাধ্যতার ফলশ্রুতিতে যে বিনয়াবনত চিত্তের উন্মেষ হয় তা অহংকার ও উদ্ধতপূর্ণ সাধুতার চেয়েও উত্তম ।” হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের (রা) বাণীতে আমরা বর্ণনার প্রতিধ্বনি পাই : “ যে ভাল কাজ মানুষের মনে অহংকার আনে তার চেয়ে আল্লাহ তার উপর মুসিবতকেই পছন্দ করেন।” ইবনে মাসুদ বলেন, “ধ্বংসের দু’টি প্রধান লক্ষণ হচ্ছে অহঙ্কার ও নৈরাশ্য। অধ্যবসায় ও সংগ্রাম ছাড়া সুখ অর্জন করা যায় না। একজন অহংকারি ব্যক্তি অধ্যবসায়ী হতে পারে না। কারণ সে নিজেকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত বলে মনে করে। আর হতাশ ব্যক্তি কোনো চেষ্টাই চালায় ন। কারণ এটাকে সে অর্থহীন মনে করে।”

আবার আসুন দেখা যাক চরমপন্থার চরম রূপ কী। চরমপন্থী গ্রুপ অন্য সকল মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার অধিকারী অস্বীকার করে। অতএব প্রতিপক্ষকে হত্যা এবং তার বিষয় সম্পত্তি ধ্বংস করার পন্থা বেছে নেয়। এই অবস্থা তখন সৃষ্টি হয় যখন চরমপন্থী গ্র“প তাদের বাইরে অন্য সকলকে কাফির বলে ভাবতে শুরু করে। এ ধরনের চরমপন্থার ফলে বাকী সমস্ত উম্মাহর সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। প্রাথমিক যুগে খারিজীরা ঠিক এমনিফাঁদে পড়েছিলো। অথচ তারা নামায, রোযা ও কুরআন তিলাওয়াতের মতো ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ছিলো। কিন্তু তাদের চিন্তাধারা ছিলো বিকৃত। তাদের বিশ্বাস ও আচরণে প্রচন্ড গোঁড়ামীর দুরুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও সহজ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা) এদের সম্পর্কে আভাস দিয়েছিলেন এভাবে: “তাদের (আলখাওয়ারিজ) নামায, কিয়াম ও তিলাওয়াতের তুলনায় তোমাদের মধ্যে কারো নামায, কিয়াম ও তিলাওয়াত অনুল্লেখযোগ্য মনে হবে।” তথাপি তিনি তাদের সম্পর্কে বলেন, “তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে। কিন্তু গলার বাইরে যাবে না এবং কোনো রকম স্বাক্ষর ছাড়াই তারা ধর্মের পথ অতিক্রম করবে।” (মসলিম)

রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেন, “তারা মুসলমানদেরকে খতম করা এবং মুশরিকদের রক্ষা করা তাদের কর্তব্য বলে মনে করবে।” (মসলিম)

এ কারণে কোনো মুসলমান খারিজীদের হাতে পড়লে নিজেকে আল্লাহর বাণী ও কিতাব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী মুশরিক বরে পরিচয় দিতো। একথা শুনে খারিজীরা তাকে প্রাণে বাঁচাতো এবং নিরাপদে গন্তব্য স্থানে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দিতো। তাদের কার্যকলাপের সমর্থনে তারা কুরআনের এই আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করতো: “কোনো মুশরিক আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়, তারপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও। কারণ তারা জ্ঞান রাখে না।” (৯:৬)

পরিতাপের বিষয় এই যে, আটক লোকটি যদি স্বীকার করতো যে, সে মুসলমান তবে তাকে খারিজীরা হত্যা করতো। দুর্ভাগ্যজনক যে, কোনো কোনো মুসলমান এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেননি। জামায়াত আত-তাকফির আল-হিজরা মনে হয় খারিজীদের পদচিহ্ন ধরেই এগোচ্ছে। যারা পাপ করে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে না তাদেরকে এই জামায়াত কাফির বলে মনে করে। যেসব শাসক শাসন কাজে শরীয়ত প্রয়োগ করেন না এবং যেসব শাসিত এদের আনুগত্য করে উভয়েই এদের চোখে ধিক্কৃত। আর যেসব আলিম উভয় পক্ষকে কাফির বলে নিন্দা করেন না তারাও ধিক্কৃত। যারা এই গ্রুপের কর্মসূচী প্রত্যাখ্যান করে কিংবা চার ইমামের অনুসরণ করে তাদেরকেও এরা কাফির বলে মনে করে। কেউ যদি তাদের দলে গিয়ে কোনো কারণে দল ত্যাগ করে তবে তাকে মুরতাদ বলে অবশ্যই হত্যা করা হবে। তারা ৪র্থ শতাব্দীর পরবর্তী যুগকে অজ্ঞতা ও কুফরীর যুগ বলে অভিহিত করে। এভাবে এই গ্রুপ কুফরীর অপবাদ দিতে এতোই পারঙ্গম যে, এদের হাত থেকে জীবিত মৃত কেউই রেহাই পায় না। বস্তুত এভাবে এই গ্রুপ গভীর পানিতে পড়েছে। কেননা কাউকে কুফরীর অপবাদ দেয়ার পরিণতি মারাত্মক। তার জীবন ও সম্পত্তির বাজেয়াপ্তি তখন আইনসিদ্ধ হয়ে যায়। তার সন্তান ও স্ত্রীর ওপর অধিকার থাকবে না; সে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, কেউ তার উত্তরাধিকারীও হতে পারবে না; তার দাফন ও জানাযা নিয়েও সমস্যা সৃষ্টি হবে। কেননা তাকে মুসলমানদের গোরস্তানে জায়গা দেয়া যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি!

রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন, “যখন কোনো মুসলমান আরেক মুসলমানকে কাফির বলে তখন তাদের মধ্যে নিশ্চয় একজন তাই।” (বুখারী)

এর অর্থ, কুফরীর অভিযোগ প্রমাণিত না হলে যে অভিযোগ আনবে তার ওপরেই ঐ অভিযোগ বর্তাবে, যার মানে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন মুসিবতের সম্মুখীন হবে। উসামা বিন জায়িদ বলেন: “যদি কোনো ব্যক্তি বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তাহলে ইসলামের মধ্যে দাখিল হলো এবং (ফলত) তার জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা পেয়ে গেলো। কিন্তু যদি সে ভয়ে কিংবা তলোয়ারের মুখে একথা বলে তবে তার জওয়াবদিহি আল্লাহÍ কাছেই তাকে করতে হবে। কেবল দৃশ্যমান ঘটনারই আমরা (বিচার) করতে পারি।” (বুখারী)

হযরত উসামা (রা) এক যুদ্ধে এক ব্যক্তি কলেমায়ে শাহদাত উচ্চারণ করার পরেও তাকে হত্যা করেছিলেন। ঐ ব্যক্তির গোত্র যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সা) এ কথা জানতে পেরে উসামার (রা) কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। তখন তিনি বলেন, “আমি মনে করেছিলাম ঐ ব্যক্তি হয়তো আশ্রয়ের আশায় এবং ভীত হয়ে কলেমা পাঠ করেছে। ” রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করলেন, “আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই-এই স্বীকারোক্তির পরেই কি তুমি তাকে হত্যা করেছিলে? উসামা (রা) বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) বার বার আমাকে এই প্রশ্ন করতে লাগলেন যতোক্ষণ না আমার মনে হলো এই দিনটির আগে আমি ইসলাম গ্রহণই করিনি।”

শরীয়ত আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, যারা সচেতনভাবে ও স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে, সাক্ষ্য ও ঘটনাবলী দ্বারা সুপ্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে ইসলাম থেকে বহিস্কৃত করা যাবে না। খুন, ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদির মতো কবীরা গুনাহ করলেই কারো বিরুদ্ধে কুফরীর অভিযোগ আনা যাবে না-অবশ্য এতটুকু দেখতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীয়তের প্রতি অস্বীকৃতি বা অশ্রদ্ধা আছে কিনা। এ কারণে ঠান্ডা মাথায় হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির আত্মীয় ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও কুরআন ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। কুরআন বলছে: “তবে তারা ভাইয়ের তরফ থেকে কাউকে কিছু মাফ করে দেয়া হলে প্রচলিত নিয়মের অনুসরণ করবে এবং সততার সাথে তাকে তা প্রদান করতে হবে।” (২:১৭৮) যারা একজন মদ্যপায়ীকে অভিশাপ দিয়েছিলো তাদের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন: “তাকে অভিশাপ দিও না। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) কে ভালবাসে।” (বুখারী)

ঐ মদ্যপায়ী ইতিপূর্বে কয়েকবার মদ্যপানের অভিযোগে শাস্তি ভোগ করেছিলো। উপরন্তু খুন, ব্যভিচার ও মদ্যপানের মতো অপরাধের জন্যে শরীয়ত ভিন্ন ভিন্ন রকম শাস্তির বিধান করেছে। এগুলো যদি কুফরই হতো তবে তো তাদেরকে রিদ্দার (ইসলাম ত্যাগের) বিধি মুতাবিক দন্ড দেয়া হতো!

চরমপন্থীরা যেসব দুর্বোধ্য বায়বীয় প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ খাড়া করে, কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক ও দ্ব্যর্থহীন ভাষ্যে তা খন্ডন করা হয়েছে। এই বিষয়টি বহু শতাব্দী পূর্ব থেকে একটি মীমাংসিত বিষয়, অতএব এর পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টা নিরর্থক।.

ইসলামে নান্দনিক শ্রবণীয় শিল্প ঃ ড। ইউসূফ আল কারযাভী

ফেব্রুয়ারি 11, 2010

ইসলাম সব সময় সুন্দরের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকে এবং মানুষের সেই ইন্দ্রকে জাগ্রত করতে আগ্রহী যা তাকে বিভিন্ন ভাবে সৌন্দর্য উপভোগ করতে শেখায়।
কিছু কিছু ‘সুন্দর’ শ্রবণইন্দ্রের কাছে ধরা পড়ে, আবার কিছু কিছু ‘সুন্দর’ তার দর্শন ইন্দ্রের কাছে আর কিছু অপরাপর ইন্দ্রের কাছে ধরা পড়ে। এখানে “শ্রবণীয় সুন্দর্য” আলোচনা করা হবে, অর্থাত্ গান সম্পর্কে, হোক বাজনা সহকার আর বাজনা বিহীন।

গান ও বাজনা সম্বন্ধে ইসলামের হুকুম কি?

এটা এমন একটা প্রশ্ন যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে শুনা যায়। এটা এমন একটা প্রশ্ন যার জবাব দানে আজকে সমগ্র মুসলিম জাতি দ্বিধাবিভক্ত। তাদের জবাবের বিভক্তির কারণে তাদের আচার আচরণও বিভিন্ন ধরণের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সব ধরণের গান ও বাজনা কান পেতে শুনে একথা বলে যে, তা হালাল জীবনের অপরাপর হালাল বস্তুর মতো, যা আল্লাহ পাক তার বান্দাদের জন্য হালাল করেছেন।

আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে কোন গানের শব্দ পেলে রেডিও বন্ধ করে দেয় বা নিজের কান বন্ধ করে নেয়। তারা বলে গান হলো শয়তানের বাঁশি ও বেহুদা কথা, যা আল্লাহর যিকির ও নামাজ থেকে বিরত রাখে, বিশেষত গায়ক যদি কোন নারী। কারণ তাদের মত নারীর কণ্ঠস্বর গান ছাড়াই সতরের অন্তর্ভুক্ত, আর যদি তা গানে হয় তাহলে(তা সহজে অনুমেয়)। তারা তাদের এ অভিমতে পক্ষে আলকোরানের কতিপয় আয়াত, কিছু হাদীস ও কিছু আলেমের অভিমত ও উক্তি দ্বারা দলিল দিয়ে থাকেন।

আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে কোন ধরণের বাজনা প্রত্যাখ্যান করেন, এমন কি রেডিও ও টিভির সংবাদের পূর্বে প্রচারিত বাজনা পর্যন্ত।

তৃতীয় আর একদল এই দুইদলের মধ্যে দ্বিধা দন্দ্বে ভোগেন। তারা কখনো একদলের পক্ষে কখনো অন্যদলের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর এরা অবশ্য এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইসলামের আলেমদের কাছ থেকে একটা মনে প্রশান্তি আনয়ণকারী চূড়ান্ত ফায়সালা কামনা করে। যা মানুষের আবেগ অনুভূতি ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃ্ক্ত। বিশেষত শ্রবণীয় ও দর্শনীয় প্রচার মাধ্যম মানুষের বাড়ি ঘরে ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় প্রবেশ করার পর, এবং তার গান ও মিউজিক বাধ্য ও অবাধ্য ভাবে তাদের শ্রবণ ইন্দ্রকে আকর্য়ণ করার পর।

বাদ্যযন্ত্র তথা মিউজিকসহ গান ও বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গান এমন একটি বিষয় যা নিয়ে ইসলামের আলেমদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক দীর্ঘ দিন থেকে চলছে।তারা কিছু বিষয়ে ঐক্যমত্যে উপনিত হয়েছেন আবার কিছু বিষয়ে মতদ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছেন।

তারা ঐক্যমত্যে উপনীত হয়েছেন ঐ সব গান হারাম হবার ব্যাপারে যাতে অশ্লীলতা ও ফাসেকী রয়েছে, এবং যা গুনাহের কাজে উদ্ভুদ্ধ করে। কারণ গানতো মূলত কথাই- তার মধ্যে যা ভালো তা ভালো আর যা মন্দ তা মন্দই। যে সব উক্তিতে হারাম কিছু রয়েছে তাও হারাম। অতএব তার সাথে যদি ছন্দ সূর ও হৃদয়গ্রাহী কিছু থাকে তাহলে তার অবস্থা কিরূপ হবে?(তা সহজে অনুমেয়)।

তেমনি ভাবে তারা আরও ঐক্যমত্যে উপনীত হয়েছেন পূর্বোক্ত বিষয় মুক্ত গান হালাল হবার ব্যাপারে, যা বাদ্যযন্ত্র মুক্ত স্বভাব সূলভ ভাবে অনুত্তেজিত করণার্থে গাওয়া হয়ে থাকে। আর তাও বৈধ আনন্দ বিনোদনের স্থানে। যথা বিয়ের অনুষ্ঠানে, কাউকে স্বাগত জানাবার কালে এবং ঈদের দিন ইত্যাদিতে। তবে শর্ত হলো তাও পর পুরুষের সামনে কোনো নারীর কন্ঠে হওয়া চলবেনা।

এ প্রসঙ্গে কিছু সুস্পষ্ট কুরান ও হাদিসের বাণী রয়েছে যা আমরা পরে উল্লেখ করব।

এছাড়া বাকি গানের ব্যাপারে তারা সুস্পষ্ট মতদ্বন্দ্বে লিপ্ত। তাদের মধ্যে কেউ সব ধরনের গানকে হালাল মনে করেন তা বাদ্যযন্ত্র সহ হোক আর বাদ্যযন্ত্র বিহীন হোক। আর কেউ কেউ সব ধরণের হারাম ঘোষণা করেছেন তা বাদ্য যন্ত্র সহ হোক বা বাদ্য যন্ত্র বিহীন হোক এমন কি তা শুনা পর্যন্ত কবীরা গুনাহ বলেও উল্লেখ করেছেন।

বিষয়টির গুরুত্বের কারণে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। এবং বিভিন্ন দিক থেকে এ প্রসঙ্গে আলোচনা পর্যালোচনা করা আবশ্যক মনে হয়, যাতে মুসলমানেরা এর মধ্য হতে হারাম থেকে হাললকে আলাদা করে নিতে পারেন এবং অকাট্য দলিলের অনুসরণ করতে পারেন। তাদেরকে যেন কারো কথার তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ করতে না হয়। এর মাধ্যমেই তারা সুস্পষ্ট দলিল নির্ভর এ দ্বীনি বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হতে পারেন।

চলবে…।

মূলত সব কিছু হালাল

ইসলামের আলেমগণ এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মূলত যে কোন বস্তু হালাল। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الأَرْضِ جَمِيعاً

তিনিই সে সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত।

He it is Who created for you all that is on earth. ( সূরা আল-বাকারা ঃ ২৯)

কাজেই কোন কিছু সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ নাস তথা আল-কুরআন ও সহীহ হাদিস কিংবা নির্ভরযোগ্য প্রমাণীত ইজমা ছাড়া হারাম হতে পারেনা। অতএব কোন নাস (আল-কুরআন ও সহীহ হাদিস) ও ইজমা না থাকলে, অথবা কোন কিছুকে হারাম ঘোষণা করে কোন সুস্পষ্ট নাস আছে কিন্তু তা সহীহ না হলে, কিংবা সহীহ কিন্তু সুস্পষ্ট না হলে সে নাস ঐ বস্তু হালাল হবার ব্যাপারে কোন প্রভাব ফেলবেনা। বস্তুটি বিস্তৃত হালালের গণ্ডিতেই বাকি থাকবে। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُرِرْتُمْ

অথচ আল্লাহ ঐ সব জন্তুর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যেগুলোকে তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন; কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্যে হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও।

while He has explained to you in detail what is forbidden to you, except under compulsion of necessity (সূরা আল-আন’আম ১১৯)

আর রাসূল (স)বলেন, যা আল্লাহ তা’আলা তার কিতাবে হালাল করেছেন তা হালাল, আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যে সব বিষয়ে নিরবতা অবল্বন করেছেন তা মাফকৃত। সুতরাং তোমরা আল্লাহর মাফকৃত বস্তু গ্রহণ করো। কারণ আল্লাহ তা’আলা কোন কিছু ভুলে যাননি। অতপর তিনি তেলাওয়াত করেছেন- نَسِيًّا وَمَا كَانَ رَبُّكَ “সবই তাঁর এবং আপনার পালনকর্তা বিস্মৃত হওয়ার নন। and your Lord is never forgetful, সূরা মারিয়াম ৬৪ । (হাদিসটি হাকেম আবুদ দারদা থেকে বর্ণনা করেন এবং সহীহ বলে মন্তব্য করেন, হাদিসটি বাযযারও বর্ণনা করেছেন।)

তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তা’আলা কিছু কাজ ফরয করে দিয়েছেন তোমরা তা তরক করোনা। আর কিছু ব্যাপারে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তোমরা সে সীমা লংঘন করোনা। আর তোমাদের দয়া পরবশ হয়ে (ভুলে গিয়ে নয়) কিছু বিষয়ে নিরব থেকেছেন সে সব বিষয়ে অনুসন্ধান করোনা।

(দারেকুতনী কর্তৃক আবু সালাবা আল খশনী থেকে বর্ণিত, হাফেজ আবু বকর মোসআলী তার আমানী নামক গ্রন্থে আর নব্বী তার আরবাঈনে হাদিসটি হাসান বলে মন্তব্য করেছেন।)

এটাই যদি শরীয়াতের মূলনীতি হয়, তাহলে কোন নাস বা দলিলের ওপর ভিত্তি করে গান হারাম ঘোষণাকারীরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন ? আর গান বৈধ ঘোষণাকারীদেরই বা এ ব্যাপারে অবস্থান কি ? তা জানা অবশ্যক।

গান হারাম ঘোষণাকারীদের দলিল ও তার পর্যালোচনা

ক. গান হারাম ঘোষণাকারীরা ইবনে মাসউদ ইবনে আব্বাস ও কোন কোন তাবেয়ী থেকে বর্ণিত এক বর্ণনার উপর নির্ভর করেছেন। তারা নিম্নোক্ত আল্লাহ তা’আলার বাণীর উপর ওপর নির্ভর করেই গান হারাম ঘোষণা করেছেনঃ-

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ

একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।

And of mankind is he who purchases idle talks to mislead from the Path of Allâh without knowledge, and takes it by way of mockery. For such there will be a humiliating torment (সূরা লোকমান ঃ ৬)

তারা আলোচ্য আয়াতের لَّ عَن سَبِيلِ (লাহুল হাদিস) বা “অবান্তর কথা বার্তা” এর ব্যাখ্যা করেছেন গান বলে।

ইবনে হাযম বলেন, কয়েকটি কারণে এই ব্যাখ্যাটি আমার কাছে গ্রহণ যোগ্য নয়। ১. রাসুল সাঃ ছাড়া আর কারো কথা হজ্জত বা গ্রহণ যোগ্য নয়। ২. এই ভাবে ব্যাখ্যা কারীরা অপরাপর সাহাবী ও তাবেয়ীদের ব্যাখ্যার বিরোধীতা করেছেন। ৩. স্বয়ং এই আয়াতের বাক্যাবলী তাদের এ ব্যাখ্যা ও দলিলকে বাতিল করে। কারণ তাতে রয়েছে- “ এক শ্রেণীর মানুষ আছে যে যারা আল্লাহ তাআলার পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথা-বার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে”।

তিনি আরও বলেন, কোন মানুষ যদি আল কোরানও খরিদ করে তার দ্বারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার জন্য এবং তাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করার জন্য তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতে এইরূপ কর্মের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ কখনো যারা অবান্তর কথা-বার্তা আনন্দ বিনোদন এবং মনে প্রশান্তি আনয়নের জন্য খরিদ করে, আল্লাহর পথকে গোমরাহ করার জন্য খরিদ করেনা। তাই আল্লাহ এখানে তাদের নিন্দা করেন নি। অতএব তাদের আয়াতের ঐ ব্যাখ্যার সাথে আয়াতের কোন সম্পর্ক থাকাটাই বাতিল বলে প্রমাণিত হলো।তেমনি ভাবে যারা কোরান তেলাওয়াতে ব্যস্ত থেকে কিংবা হাদিস অধ্যায়নে ব্যস্ত অথবা কথা-বার্তায় ব্যস্ত থেকে অথবা গান-বাজনা নিয়ে ব্যস্ত থেকে কিংবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে নামাজ ছেড়ে দেয় সেও ফাসিক- আল্লাহর নাফরমান। আর যে উপরোক্ত কাজে ব্যস্ত থেকেও কোন ফর্য কাজে গাফেল হয়ে পড়েনা তিনি সত্কর্মশীল । (দলিল- ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, মুনীরিয়া ৯ পৃ.৬০)
খ. তারা মুমিনের প্রশংসায় উল্লেখিত আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা দলিল দিয়েছেন,-
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ
আর যখন অনর্থক কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে বিমুখ হয়ে পড়ে।
And when they hear Al¬Laghw they withdraw from it and say: (সূরা আল-কিসাস ঃ ৫৫)
তাদের মতে গান যা অনর্থক কথা-বার্তার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তার থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
এ বক্তব্যের জবাবে বলা যায়, এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হলো এখানে লাগভ বা অনর্থক কথা-বার্তা বলতে গালা-গালী ও তিরস্কার জাতীয় মন্দ কথা বুঝানো হয়েছে। আয়াতের বাকি অংশও তাই প্রমাণ করে, আল্লাহ তা’আলা বলেন,-
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
আর যখন অনর্থক কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে বিমুখ হয়ে যায় এবং বলে, আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।। (সূরা আল-কিসাস ঃ ৫৫)
মূলত আয়াতটি আল্লাহর বান্দাদের প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত আয়াতের মতোই,-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
যখন অজ্ঞরা তাদের সম্বোধন করে তখন তারা বলে তোমাদের প্রতি সালাম ।
when the foolish address them they reply back with mild words of gentleness. (সূরা আল-ফোরকানঃ৬৩)
যদি আমরা ধরে নেই যে, উক্ত আয়াতের লাগভ বা অনর্থক কথা-বার্তা গানকেও শামিল করে তাহলেও আমরা দেখতে পাই যে, আয়াতটি গান শুনা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব বা উত্তম ও প্রশংসনীয় কাজ বলে প্রমাণ করে। গান শুনা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব প্রমাণ করেনা।
“লাগভ” শব্দটি “বাতিল” শব্দের মতোই অনর্থক বেফায়দা বুঝায়, বেফায়দা কিছু শুনা কখনও হারাম নয়, যতক্ষণ না তার কারণে কোন হক বিনষ্ট হয়, কিংবা তা কোন ওয়াজিব কর্ম থেকে বিরত রাখে।
ইবনে জোরাইজ থেকে বর্ণিত যে, তিনি গান শুনা বৈধ মনে করতেন। তাকে জিজ্ঞাস করা হলো, গান কিয়ামত দিবসে আপনার সত্কর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে, না কুকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে? তিনি জবাবে বলেন, তা না সত্কর্মের আর না কুকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে, কারণ তাতো অনর্থক বা লাগভ কথারই মতোই। আল্লাহ তা’আলা বলেন,-
لاَ يُؤَاخِذُكُمُ اللّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ
আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে তোমাদের (লাগভ) অনর্থক শপথের জন্যে দায়ী করবেন না।
Allâh will not punish you for what is uninentional in your oaths, (সূরা আল-বাকারা ঃ ২২৪, সূরা আল মায়েদা ঃ ৮৯)
ইমাম গাজ্জালী বলেন, যদি আল্লাহর নামে অর্থহীন শপথ করার কারণে- যাতে দৃঢ় প্রত্যয় ও ইচ্ছা থাকেনা এবং বিরোধিতা করার চিন্তা-ভাবনাও থাকেনা- আল্লাহ তা’আলা দায়ী না করেন তাহলে কি করে ভাবতে পারি যে, কবিতা গাওয়া ও নৃত্যের জন্য দায়ী করবেন। (ইমাম গাজ্জালী, এহইয়াউ উলুমুদ্দিন, মিসর ঃ দারুশ শা’আব, কিতাবুস সিমা, পৃষ্টা ১১৪৭)
চলবে….
.

সংক্ষেপে হাদীস সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচারের ইতিহাস

ফেব্রুয়ারি 10, 2010

সংক্ষেপে হাদীস সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচারের ইতিহাস
আমরা এ প্রজন্মের মানুষের মধ্যে হাদীস সংকলন, সংরক্ষণ ও প্রচার নিয়ে নানা ধরণের প্রচারণায় বিভ্রান্ত। এখানে এ যুগের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব প্রফেসর ডাঃ মোঃ মাতিয়ার রহমান সাহেবের গবেষণা সিরিজ ১৯ সংগৃহিত। কৃতজ্ঞতা- কোরান রিচার্স ফাউন্ডেশন।

রাসূল (সা.) এর মক্কী জীবনের সময় হাদীস সংক্ষরণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
নবুয়াতের শুরু থেকেই কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে সাথে নিজের তত্ত্বাবধানে রাসূল (সা.) তা লিখে রাখার ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু শুরু থেকে যত দিন পর্যন্ত মুসলমানরা বর্ণনা ভঙ্গি, উপস্থাপন পদ্ধতি, বিষয়বস্তু ইত্যাদি দেখে কোনটি কুরআনের আয়াত আর কোনটি তা নয়, এটি বুঝতে পারার যোগ্যতা অর্জন করেনি ততদিন পর্যন্ত হাদীস লিখতে রাসূল (সা.) নিষেধ করেছেন। এটি তিনি করেছিলেন কুরআনের সাথে তাঁর কথা মিশে যাওয়ার মাধ্যমে ইসলামের অকল্পনীয় ক্ষতি এড়ানোর জন্যে। হাদীস সংগ্রহ এ বিষয়ে তাঁর যে বক্তব্য পাওয়া যায় তার একটি হচ্ছে-
لاَ تَكْتُبُوا عَنِّي وَمَنْ كَتَبَ عَنِّي غَيْرَ الْقُرْآنِ فَلْيَمْحُهُ وَحَدِّثُوا عَنِّي وَلاَ حَرَجَ وَمَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
অর্থ: আমার বলা কথা লিখ না। কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু কেউ লিখে থাকলে তা মুছে ফেল। তবে আমার কথা মৌখিকভাবে বর্ণনা করায় দোষ নেই। আর আমার নামে যে মিথ্যা প্রচার করবে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা খুঁজে নেয়। (মুসলিম : আবু সাইদ খুদরী (রা.)
রাসূল (সা.) এর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে মক্কী জীবনে হাদীস লিখে সংক্ষরণ করা হয়েছে বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তখন হাদীস সংরণের একমাত্র উপায় ছিল মুখস্থ রাখা। আর হাদীস প্রচারের একমাত্র উপায় ছিল মৌখিক প্রচার।
রাসূল (সা.) এর মাদানী জীবনের সময় হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
হিজরতের পর তথা নবুয়্যাতের ১৩-১৪ বছর পর মুসলমানরা যখন, কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য স্পষ্টভাবে বুঝার যোগ্যতা অর্জন করেছেন, তখন রাসূল (সা.) হাদীস লেখার সাধারণ অনুমতি দেন। এ ব্যাপারে উপস্থিত থাকা রাসূল (সা.) এর কয়েকটি হাদীসের একটি হচ্ছে-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.) এর হতে শোনা প্রতিটি কথা সংরণের জন্যে লিখে নিতাম। এটি দেখে কুরাইশ সাহাবীগণ আমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করেন। আমাকে তাঁরা বলেন- أَتَكْتُبُ كُلَّ شَيْءٍ تَسْمَعُهُ، وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَشَرٌ يَتَكَلَّمُ فِي الْغَضَبِ وَالرِّضَا؟
অর্থ: তুমি রাসূল (সা.) এর মুখে যা শোন তা সবই লিখে রাখ? অথচ রাসূল (সা.) একজন মানুষ। তিনি কখনও সন্তোষ ও কখনও রাগের মধ্যে থেকে কথা বলেন। (আবু দাউদ, কিতাবুল ইলম)
হজরত আবদুল্লাহ বলেন, অতঃপর আমি হাদীস লেখা বন্ধ করে দেই এবং একদিন রাসূল (সা.) এর নিকট বিষয়টি উপস্থাপন করি এবং বলি, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কুরাইশরা বলে তুমি রাসূলের সব কথাই লিখছ? অথচ তিনি একজন মানুষ। সাধারণ মানুষের মত তিনি কখনও কখনও রাগান্বিত হয়ে থাকেন’। রাসূল (সা.) এ কথা শুনার সাথে সাথে নিজের দুই ঠোঁটের দিকে ইশারা করে বললেন-اُكْتُبْ فَوَ الَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ اِلاَّ الْحَقّ.
অর্থ: তুমি লিখতে থাক। যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, আমার এই মুখ হতে প্রকৃত সত্য কথা ছাড়া কিছুই বের হয় না।
এ কথা শুনার পর হজরত আবদুল্লাহ (রা.) রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন-يَا رَسُوْلَ اللهِ اَكْتُبُ كُلَّ مَا اَسْمَعُ مِنْكَ.
অর্থ: হে রাসূল (সা.) আপনার নিকট থেকে যা কিছু শুনতে পাই তা সবই কি লিখে রাখব? রাসূল (সা.) বললেন,………..(হ্যাঁ)। আবদুল্লাহ (রা.) পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, ক্রুদ্ধ ও সন্তোষ উভয় অবস্থায় বলা সব কথাই কি লিখব? তখন রাসূল (সা.) চূড়ান্তভাবে বললেন-
نَعْمْ فَاِنِّىْ لاَ اَقُوْلُ فِىْ ذَلِكَ كُلِّهِ اِلاَّ حَقًّا. অর্থ: হ্যাঁ এ সকল অবস্থায়ও আমি প্রকৃত সত্য ছাড়া কিছুই বলি না।
(দারেমী, আবু-দাউদ, মুসনাদে আহমদ, মুস্তাদরাকে হাকেম, জামে বায়ানুল ইলমে ইবানুল বার)
এ ধরনের কিছু হাদীস থেকে জানা যায় মাদানী জীবনে রাসূল (সা.) হাদীস লেখার সাধারণ অনুমতিই শুধু দেননি হাদীস লেখার পথে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তিনি তা দূর করে দিতেন। রাসূল (সা.) এর অনুমতি ও উৎসাহ পেয়ে এবং হাদীস নির্ভুলভাবে সংরণের গুরুত্ব অনুভব করে যে সকল সাহাবী লেখাপড়া জানতেন (অতি অল্প সংখ্যক) তারা বিচ্ছিন্নভাবে হাদীস লিখে নিজ সংগ্রহে রেখে দিতেন, এমন প্রমাণ উপস্থিত আছে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনেও রাসূল (সা.) বিভিন্ন সাহাবীর দ্বারা লিখিয়ে নিতেন। তবে রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় যেখানে কুরআন সংকলিত হয়নি সেখানে হাদীস সংকলিত হওয়ার প্রশ্ন আসে না।
মোটকথা রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় হাদীস সংরক্ষণের প্রধান উপায় ছিল মুখস্থকরণ এবং হাদীস প্রচারের প্রধান বা একমাত্র উপায় ছিল মৌখিক প্রচার। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের সময় সাহাবীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১,১৪,০০০ (এক লাখ চৌদ্দ হাজার)। এই ১,১৪,০০০ সাহাবীর সকলের পে সব সময় রাসূল (সা.) কাছে থেকে তাঁর সকল কথা শুনা বা সকল কাজ দেখা সম্ভব ছিল না। তাই অধিকাংশ সাহাবীর জানা থাকা হাদীসের মধ্যে কিছু ছিল রাসূল (সা.) এর নিকট থেকে সরাসরি শুনা বা দেখা আর কিছু ছিল অন্য সাহাবীর (রা.) নিকট থেকে শুনা বা দেখা। এ দুয়ের অংশ এক এক সাহাবীর জন্যে এক এক রকম ছিল।

খুলাফায়ে রাশেদীনের সময় পর্যন্ত হাদীস সংরণ সংকলন ও প্রচার পদ্ধতি
রাসূল (সা.) যতদিন জীবিত ছিলেন ততোদিন কারো পক্ষে তাঁর নামে মিথ্যা কথা প্রচার করা, রাসূলের কথাকে তাঁর কথা নয় বলে উড়িয়ে দেয়া এবং রাসূল (সা.) এর কোন কথার অপব্যাখ্যা করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ ছিল না। কারণ, তেমন কিছু ঘটলেই সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূল (সা.) এর নিকট জিজ্ঞাসা করে সহজেই তার সমাধান করে নিতে পারতেন। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর এই অবস্থার বিরাট পরিবর্তন ঘটে। একদিকে ওহীর জ্ঞান লাভের সূত্র ছিন্ন হয়ে যায় অন্যদিকে অনেক নও-মুসলিম ইসলাম পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়। কিছু মুনাফিকও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা রাসূল (সা.) এর নামে মিথ্যা হাদীস রচনা করারও চেষ্টা করে।
প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ঐ মুনাফিক মুরতাদদের কঠোর হস্তে দমন করেন। হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কড়াকড়ি আরোপ করেন। বর্ণিত কোন হাদীসের সত্যতা প্রমাণিত না হওয়ার আগে তিনি তা গ্রহণ করতেন না। তবে তিনি যে কুরআনের পরেই হাদীসের গুরুত্ব দিতেন তা স্পষ্ট বুঝা যায় খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর দেয়া প্রথম ভাষণ থেকে। সেখানে তিনি বলেছিলেন-
يَاَيُّهَا النَّاسُ قَدْ وُلِّيْتُ اَمْرَكُمْ وَلَسْتُ بِخَيْرِكُمْ وَلَكِنْ نَزَلَ الْقُرْآنُ وَسَنَّ النّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ السُّنَنَ فَعَلَّمَنَا فَعَلِمْنَا.
অর্থ: হে লোকগণ, আমাকে তোমাদের (রাষ্ট্রের) দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে অথচ আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। কিন্তু কুরআন নাযিল হয়েছে এবং নবী করীম (সা.) তাঁর সুন্নাত ও আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তিনি আমাদের এই উভয় জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন এবং আমরা তা শিখে নিয়েছি। (طبقات ابن سعد ج-৩، ص-১২৯) আবু বকর সিদ্দীক (রা.) নিজে ৫০০ (পাঁচশত) হাদীসের এক সংকলন তৈরি করেছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ ভাগে তিনি নিজেই তা নষ্ট করে দেন। এর কারণ হিসেবে মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ দু’টি বিষয় উল্লেখ করেছেন-
১. তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন যে, তাঁর সংকলিত হাদীসে একটি শব্দও যদি রাসূল (সা.) এর মূল বাণীর বিন্দুমাত্র বিপরীত হয়ে পড়ে তবে রাসূল (সা.) এর সতর্কবাণী অনুযায়ী তাঁকে জাহান্নামের ইন্ধন হতে হবে।
২. তাঁর মনে এ ভয়ও জাগ্রত হয় যে, তাঁর সংকলিত হাদীস গ্রন্থকে মুসলিম জনগণ, যদি কুরআনের সমতুল্য মর্যাদা দিয়ে বসে বা অন্য সাহাবীগণের বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অধিক মর্যাদা দিতে শুরু করে, তা হলে ইসলামের বিশেষ তি হবে।
দ্বিতীয় খলীফা ওমর ফারুক (রা.) এর দৃষ্টিতেও ইসলামের ভিত্তি হিসেবে কুরআনের পরই ছিল সুন্নাহ তথা রাসূল (সা.) এর হাদীসের স্থান। তিনি অনেক হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করে ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন শাসকের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং সর্বসাধারণ্যে সে সবের ব্যাপক প্রচার করার নির্দেশও দিয়েছিলেন। ইলমে হাদীসের শিক্ষা ব্যাপকতর করার জন্যে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও করেন। কিন্তু জাল হাদীসের মারাত্মক কুফল থেকে মুসলমানদের রা করার জন্যে তিনিও আবু বকর (রা.) এর ন্যায় হাদীস বর্ণনা ও গ্রহণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করেন। আবু মুসা আশআরী (রা.) এর বর্ণিত একটি হাদীসের সত্যতা প্রমাণের জন্যে তিনি তাঁকে বলেছিলেন-لَتَاْتِيْنِىْ عَلَى ذَلِكَ بَيِّنَةٌ اَوْ لَاَفْعَلَنَّ بِكَ.
অর্থ: দলিল পেশ কর নইলে তোমাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।(تذكرة الحفاظ ج-১، ص-৮. الحديث و المحدثون ص-৮০)
পরে তার সমর্থনে অপর এক সাহাবীকে পেশ করা হলে তিনি আশ্বস্ত হন।
হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর সময়ই বিচ্ছিন্ন থাকা হাদীস সম্পদ সংকলন করার প্রশ্ন প্রথম উত্থাপিত হয়। ওমর (রা.) নিজেই এ বিরাট কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বিষয়টি নিয়ে অন্যান্য সাহাবীর সাথে পরামর্শ করেন। মুসলমানরা তাঁর অনুকূলেই পরামর্শ দেন। কিন্তু পরে তাঁর নিজের মনে এ সম্পর্কে দ্বিধা ও সন্দেহ উদ্রেক হওয়ায় এক মাস ধরে চিন্তা-ভাবনা ও ইস্তেখারা করেন। শেষে তিনি নিজেই একদিন বললেন-
اِنِّىْ كُنْتُ ذَكَرَتُ لَكُمْ مِنْ كِتَابَةِ السُّنَنِ مَا قَدْ عَلِمْتُمْ. ثُمَّ تَذَكَّرْتُ فَاِذَا اُنَاسٌ مِنْ اَهْلِ الْكِتَابِ قَبْلَكُمْ قَدْ كَتَبُوْا مَعَ كِتَابِ اللهِ كُتُبًا فَاَكَبُّوْا عَلَيْهَا وَتَرَكُوْا كِتَابَ اللهِ وَ اَنِّىْ وَاللهِ لاَ اُلَبِّسُ كِتَابَ اللهِ بِشَيْءٍ فَتَرَكَ كِتَابَ السُّنَنِ.
অর্থ: আমি তোমাদের হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কথা বলেছিলাম এ কথা তোমরা জান। কিন্তু পরে মনে হল তোমাদের পূর্বের আহলে কিতাবরাও এমনিভাবে নবীর কথা সংকলিত করে কিতাব রচনা করেছিল এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করেছিল। আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিছুই মিশাবো না। অতঃপর তিনি হাদীস সংকলিত করার সংকল্প ত্যাগ করেন।
(مقدمة تنوير الحوالك موطا امام مالك ص-২، تقيد العلم ص-১৫০، جامع بيان العلم:ج-১، ص-৬৪، طبقات ابن سعد: ج-৩، ج-১، ص-২.৬، كنـز العمال، العلى متفى الهند:ج-৫، ص-২২৯)
বস্তুত সুসংবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস গ্রন্থ পেয়ে লোকেরা হয়তো কুরআন থেকে তাকে বেশি গুরুত্ব দিবে এবং কেবল হাদীস অনুযায়ীই চলতে শুরু করবে, শুধুমাত্র এ ভয়েই ওমর (রা.) হাদীস সংকলনের কাজ পরিত্যাগ করেন। তিনি এটাকে যে নাজায়েয মনে করতেন না, তা তাঁর পূর্বোল্লিখিত কার্যকলাপ থেকে সহজে জানা ও বুঝা যায়।
হজরত উসমান (রা.) এর বর্ণনা করা হাদীসের সংখ্যা কম থাকার বিষয়ে তাঁর নিজের বক্তব্য হচ্ছে-
مَا يُمْنِعُنِىْ اَنْ اُحَدِّثَ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنْ لاَ اَكُوْنَ اَوْعَى اَصْحَابِهِ عَنْهُ وَلَكِنِّىْ اَشْهَدُ لَسَمِعْتُهُ يَقُوْلُ مَنْ قَالَ عَلَى مَالَمْ اَقُلْ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
অর্থ: রাসূল (সা.) এর সাহাবীদের মধ্যে আমি কম হাদীস জানি এটি রাসূল (সা.) এর হাদীস বর্ণনা থেকে আমার বিরত থাকার কারণ নয়। আসল কারণটি হচ্ছে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমি নিজেই রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, আমি যা বলিনি যদি কেউ তা আমার কথা হিসেবে বর্ণনা করে তবে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়। (طبقات ابن سعد-৩، ق اول، ص-৩৯، مسند امام احمد: ج-১، ص-২৫) তাই হজরত উসমান (রা.) এর বর্ণনা করা কয়েকটি মাত্র হাদীস পাওয়া যায়।
হজরত আলী (রা.) হচ্ছেন সে কজন সাহাবীর মধ্যে এমন যাঁরা নিজ হাতে রাসূল (সা.) এর হাদীস লিখে রেখেছিলেন। তাঁর লিখিত হাদীস ভাঁজ করে তিনি তাঁর তলোয়ারের খাপে রেখে দিয়েছিলেন। (বুখারী, মুসনাদে আহমদ)

সাহাবীদের যুগ প্রায় শেষ হওয়া পর্যন্ত (১ম হিজরী শতকের শেষ পর্যন্ত) হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
খুলাফায়ে রাশেদার শেষ পর্যায়ে মুসলিম সমাজে নানাবিধ ফেতনার সৃষ্টি হয়। শিয়া ও খাওয়ারিজ দু’টি বাতিল ফিরকা স্থায়ীভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা হাদীস বানিয়ে রাসূল (সা.) এর নামে চালিয়ে দেয়ারও চেষ্টা করে। তাই হাদীস পেলে মুনাফিকরা তা বিকৃত করে প্রচার করে ক্ষতি করতে পারে বা মুসলমানরা কুরআন বাদ দিয়ে হাদীসের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়তে পারে এসব কারণে সাহাবায়ে কিরামগণ সাধারণভাবে হাদীস বর্ণনা ও প্রচার সাময়িকভাবে প্রায় বন্ধ রাখেন। শরীয়াতের মাসলা-মাসায়েলের মীমাংসা কিংবা রাষ্ট্র শাসন ও বিচার-আচার প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে যখন হাদীসের আশ্রয় গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ত কেবলমাত্র তখন তারা পরস্পরের নিকট হাদীস বর্ণনা করতেন। তবে এ সময় হাদীসের বিরাট সম্পদ ধারণ করে অসংখ্য সাহাবী অতন্দ্র প্রহরীর মত উপস্থিত ছিলেন।
দিন যত যেতে থাকে মুসলিম সমাজে তত নিত্য নতুন পরিস্থিতি ও সমস্যার উদ্ভব হতে থাকে। মুসলিম জনসাধারণের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূল (সা.) এর কথা জানা জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে জীবিত সাহাবীগণ তাদের জানা থাকা হাদীস বর্ণনা করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে ইলমে হাদীস অর্জন করার প্রবল আগ্রহ জন্মে। তারা সাহাবীদের নিকট নানাভাবে রাসূল (সা.) এর হাদীস শুনার আবদার শুরু করেন। এ কারণেও সাহাবায়ে কিরাম তাদের স্মরণে বা লিখা থাকা হাদীস প্রকাশ করতে এবং শিক্ষা দিতে প্রস্তুত হন। এ সময়ে বহু তাবেয়ী, সাহাবীদের নিকট থেকে হাদীস লিখে তা সংরক্ষণ ও প্রচারে লিপ্ত হন। হাদীস যথাযথভাবে গ্রন্থাকারে সংরক্ষণের কাজ এ পর্যায়ে কেউ করেছেন বলে ইতিহাসে কোন নজীর পাওয়া না গেলেও হাদীসের যে সকল লিখিত দলিল উপস্থিত থাকার কথা ইতিহাস থেকে জানা যায় তার কয়েকটি হচ্ছে-
১. সহীফায়ে সাদেকা-হজরত আবদুল্লাহ আমর ইবনুল আস (রা.)
এর লিখিত দস্তাবেজ। (ইন্তেকাল ৬৩ হিজরী)
২. সহীফায়ে হজরত আলী (রা.)
৩. রাসূল (সা.) এর লিখিত ভাষণ
৪. সহীফায়ে হজরত জাবির (রা.)
৫. সহীফায়ে সহীহা
৬. সহীফায়ে আনাস ইবনে মালেক (রা.)
৭. মাকতুবাতে নাফে (রহ.)
মোটকথা সাহাবীগণের সময়কাল প্রায় শেষ হওয়া পর্যন্ত (সর্বশেষ সাহাবী ইন্তেকাল করেন ১১০ হিঃ সনে) হাদীস সংরক্ষণের প্রধান উপায় ছিল মুখস্থ রাখা। আর হাদীস প্রচারের প্রধান উপায় ছিল মৌখিক প্রচার। একজন সাহাবী অন্য একজন সাহাবী বা একজন তাবেয়ী একজন সাহাবীর নিকট থেকে সরাসরি রাসূল (সা.) এর হাদীস শুনার জন্যে অকল্পনীয় কষ্ট করে অনেক দূর ভ্রমণ করেছেন, এমন ঘটনা প্রচুর পরিমাণে হাদীসগ্রন্থে ও ইতিহাসে উপস্থিত আছে।

হিজরী ১ম শতকের শেষ থেকে ২য় শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
এ সময়কালে তাবেয়ীদের এক বিরাট দল হাদীস সংগ্রহ, লিখন ও প্রচারের কাজে লেগে যায়। তাবেয়ী হচ্ছেন সেই মুমিনগণ যারা জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর কোন সাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কিছু সময় তাঁর সাথে কাটিয়েছেন এবং ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করেছেন। একমাত্র হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এর নিকট ৮০০ (আটশত) তাবেয়ী হাদীস শিা লাভ করেছেন। সাহাবীগণ যেমন রাসূল (সা.) এবং পরস্পরের নিকট থেকে হাদীস শিা লাভ করেছেন, হাজার হাজার তাবেয়ী তেমনি সাহাবী ও অপর তাবেয়ীর নিকট থেকে হাদীস শিখেছেন। সাইদ ইবনে মুসাইয়্যাব (মৃঃ ৯৩ হিঃ), ইবনে শীরীন (মৃঃ ১১০ হিঃ), নাফে (মৃঃ ১১৭ হিঃ), ইমাম জয়নুল আবেদীন, মুজাহিদ, মাসরুক, মাকহুল (মৃঃ১১৮ হিঃ), ইকরামা (মৃঃ১০৫ হিঃ), আতা (মৃঃ১১৫ হিঃ), কাতাদাহ (মৃঃ ১১৭ হিঃ), ইমাম শাবী (মৃঃ ১০৫ হিঃ), আলকামা, ইব্রাহীম নখঈ (মৃঃ ৯৬ হিঃ), ওমর বিন আবদুল আজিজ (মৃঃ ১০১ হিঃ) প্রমুখ প্রবীণ তাবেয়ীগণের প্রায় সকলে ১০ম হিজরীর পর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৮ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন। অন্যদিকে সকল সাহাবী ১১০ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন। তাই সহজেই বুঝা যায়, তাবেয়ীগণ সাহাবীগণের দীর্ঘ সাহচার্য লাভ করেছেন।
তাবেয়ী হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (জন্ম ৬১ হিঃ, মৃত্যু ১০১ হিঃ), ৯৯ হিজরী সালে খলিফা নির্বাচিত হন। তাঁর খিলাফতের মেয়াদ ছিল দুই বছর পাঁচ মাস। ঈমান, তাকওয়া ও যোগ্যতার কারণে তিনি ইসলামের পঞ্চম খলিফা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে ইসলামী জীবন-যাপন ও খিলাফত পরিচালনার জন্যে হাদীস এক অপরিহার্য সম্পদ। সাহাবায়ে কিরামের প্রায় সকলে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। অধিকাংশ তাবেয়ীও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন তারাও আর বেশি দিন থাকবেন বলে মনে হয় না। অতএব অনতিবিলম্বে এই মহান সম্পদ সংগ্রহ ও সংকলন একান্ত দরকার। এটি ভেবেই তিনি ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে নিম্নোক্ত ফরমান লিখে পাঠান-
اُنْظُرْحَدِيْثَ رَسُوْلِ اللهِ (ص) فَاجْمِعُوْا.
অর্থ: রাসূল (সা.) এর হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দাও। তা সংগ্রহ-সংকলন কর।
(فتح البارى، الموطا مالك ص-২)
মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি আবু বকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হাযমকেও তিনি নিম্নোক্তভাবে ফরমান লিখে পাঠান-
اُنْظُرْ مَاكَانَ مِنْ حَدِيْثِ رَسُوْلِ اللهِ (ص) اَوْ سُنَّتِهِ اَوْ حَدِيْثِ عُمَرَ اَوْنَحْوِ هَذَا فَاكْتُبْهُ لِىْ فَاِنِّىْ خِفْتُ دُرُوْسَ الْعِلْمِ وَ ذِهَابِ الْعُلَمَاءِ.
অর্থ: রাসূল (সা.) এর হাদীস বা তাঁর সুন্নাহ অথবা হজরত ওমরের বাণী কিংবা অনুরূপ যা কিছু পাওয়া যায় তার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্যে লিখে নাও। কেননা আমি হাদীস সম্পদের ও ইলমে হাদীসের ধারকদের বিলুপ্তির ভয় পাচ্ছি।
(موطا امام محمد، بخارى، طبقات ابن سعد، سنن الدارمى)

তিনি আরও লিখেন-
وَلاَ يُقْبَلُ اِلاَّ حَدِيْثَ النَّبِىِّ (ص) وَلِيَفْشُوْا الْعِلْمَ وَ لِيُجْلِمُوْا حَتَّى يُعْلَمَ فَاِنَّ الْعِلْمَ لاَ يَمْلِكُ حَتَّى يَكُوْنَ سِرَّ.
অর্থ: আর রাসূল (সা.) এর হাদীস ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ কর না। লোকেরা যেন ইলমে হাদীসকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে এবং হাদীস শিা দানের জন্যে মজলিস করে। যেন যারা জানে না তারা শিখে নিতে পারে। কারণ, জ্ঞান গোপন করলে তা বিনাশপ্রাপ্ত হয়। (বুখারী ১ম খণ্ড)
ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাবেয়ী ইমাম জুহরীকে বিশেষভাবে হাদীস সংকলনের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন।
(الجامع بيان العلم، طبقات ابن سعد:ص-৩৩৬، تنوير الحوالك شرح الموطا مالك)
ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের ফরমান জারি করার পর বেশি দিন জীবিত ছিলেন না (মৃত : ১০১ হিঃ)। কিন্তু তাঁর ফরমানের ফলে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের যে প্রবাহ শুরু হয়েছিল তা পরের কয়েকশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাবেয়ীগণ বিভিন্ন শহরে উপস্থিত থাকা সাহাবী বা তাবেয়ীদের নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহের জন্যে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতেন।
তাবেয়ী যুগে হাদীস সংরক্ষণ ও প্রচারের যে ক্রমপদ্ধতি ছিল তার সংপ্তিসার হল-
اَوَّلُ الْعِلْمِ الإسْتِمَاعُ ثُمَّ الإنْصَاتُ ثُمَّ الْحِفْظُ ثُمَّ الْعَمَلُ ثُمَّ النَّشْرُ.
অর্থ: প্রথমে শ্রবণ করা হতো, পরে তাতে মনোযোগ দেয়া হত, তারপর মুখস্থ করা হত, অতঃপর সে অনুযায়ী আমল শুরু হত এবং তারপর তা প্রচার করা হত। (جامع بيان العلم، ص-১১৮)
অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরামদের যুগের ন্যায় তাবেয়ী যুগেও হাদীস সংরণ ও প্রচারের প্রধান উপায় ছিল মুখস্থকরণ ও মৌখিক প্রচার।
হিজরী ২য় শতকের শুরু থেকে কনিষ্ঠ তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীনদের এক বিরাট দল সাহাবা ও প্রবীণ তাবেয়ীদের লিখিত হাদীসগুলো ব্যাপকভাবে একত্রিত করতে থাকেন। খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ.) এর সরকারি ফরমান এ ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এ যুগেই ইমাম আবু হানীফা (রা.) কর্তৃক কিতাবুল আসার নামক একটি হাদীস গ্রন্থ সংকলিত হয়। মুসলিম উম্মতের নিকট উপস্থিত থাকা হাদীস গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সর্বাধিক প্রাচীন গ্রন্থ। ইমাম আবু হানীফার পূর্বে বিছিন্নভাবে অনেকের দ্বারা হাদীস সংগৃহীত ও লিখিত হয়েছিল কিন্তু ঠিক গ্রন্থ প্রণয়নের ধারায় হাদীসের কোন গ্রন্থ সংকলিত হয় নাই। কিতাবুল আসার-এর পরপরই সংকলিত হয় ইমাম মালিক (রহ.) এর মুয়াত্তা।
প্রসিদ্ধ কয়েকজন তাবে-তাবেয়ীন হচ্ছেন-ইমাম আবু হানীফা (জন্ম ৮০ হিঃ), ইমাম মালিক (৯৩-১৭৯ হিঃ), ইমাম আবু ইউসুফ (মৃঃ ১৮৩ হিঃ), ইমাম মুহাম্মাদ শায়বানী, ইমাম আওয়ায়ী (মৃঃ ১৫৭ হিঃ), ইমাম শুবা, ইমাম সুফিয়ান সওরী (৯৭-১৬১ হিঃ), ইমাম লাইস ইবনে সায়াদ (৯৪-১৬৫ হিঃ), সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (১০৭-১৯৮ হিঃ), ইমাম ইবনে জুরাইজ (৮০-১৫০ হিঃ), ইবনে আমের।
হিজরী ২য় শতকের মাঝামাঝি থেকে ৪র্থ শতকের শেষ পর্যন্ত হাদীস সংরণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
এ যুগে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিভিন্ন দিক দিয়ে ব্যাপকতা লাভ করে। এ যুগের প্রসিদ্ধ কাজগুলো হচ্ছে-
১. মুসনাদ প্রণয়ন
তৃতীয় হিজরী শতকের প্রথম ভাগে মুসনাদ নামক হাদীস গ্রন্থ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। মুসনাদ বলা হয় সেই ধরনের হাদীস গ্রন্থকে যেখানে এক একজন সাহাবীর বর্ণনা করা সকল হাদীস বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রিত করে উল্লেখ করা হয়। এখানে হাদীস সহীহ কি সহীহ না, সেদিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া হত না। যেমন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হতে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সনদ সূত্রে যত হাদীস গ্রন্থকার মুহাদ্দিসের নিকট পৌঁছেছে, সহীহ কি সহীহ নয় সেদিকে বেশি দৃষ্টি না দিয়ে, সনদ উল্লেখপূর্বক, মুসনাদে আবু বকর সিদ্দিক শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করা, মুসনাদ গ্রন্থ প্রণয়ন করার রীতি। এ ধরনের গ্রন্থ প্রণয়ন দোষমুক্ত না হলেও এতে যে কল্যাণ আছে তা স্বীকার করতেই হবে।
কয়েকটি প্রসিদ্ধ মুসনাদ গ্রন্থের নাম গ্রন্থকারের ইন্তেকালের হিজরী সনসহ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
মুসনাদ উবায়দুল্লাহ ইবনে মুসা (মৃ. ২১৩ হিঃ), মুসনাদুল হুমায়দী (মৃঃ ২১৯ হিঃ), মুসনাদ ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), মুসনাদ উসমান ইবনে আবু শায়বাহ (মৃঃ ২৩৯ হিঃ), মুসনাদ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (জন্ম ১৬৪ হিঃ, মৃঃ ২৪১ হিঃ), আল মুসনাদুল কবীর কুরতবী (মৃ ২৭৬ হিঃ), মুসনাদ আবু দাউদ তায়ালিমী (মৃঃ ২০৪ হিঃ)।
২. আসমা-উর-রিজাল এবং হাদীস পর্যালোচনা ও সমালোচনা বিজ্ঞান প্রণয়ন
তৃতীয় হিজরী শতকে একদিকে মুহাদ্দিসগণ জলে-স্থলে ব্যাপক ভ্রমণ করে মুসলিম জাহানের প্রতি কেন্দ্রে যেমন তন্নতন্ন করে হাদীস খুঁজে বেড়াতে থাকেন অন্যদিকে তেমনি মুসলিম জাহানে নানাবিধ ফেতনার উদ্ভব হয় (বর্ণনা পরে আসছে)। ঐ ফেতনাসমূহের সাথে জড়িত প্রায় সকলেই নিজস্বভাবে কথা রচনা করে রাসূল (সা.) এর হাদীস বলে বর্ণনা করতে শুরু করে। প্রতিটি বর্ণনার সাথে মনগড়া বর্ণনাসূত্র (সনদ) এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয় যাতে মানুষ তাকে রাসূল (সা.) এর কথা বলে বিশ্বাস করতে সনদের দিক দিয়ে কোন সন্দেহে পতিত না হয়। এ কারণে প্রতিটি হাদীস, সমালোচনার কষ্টিপাথরে যাচাই করে কোনটি রাসূল (সা.) এর বাণী এবং কোনটি নয়, তা নির্ধারণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মেটাতেই আসমা-উর-রিজাল (হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবন বৃত্তান্ত) এবং হাদীস পর্যালোচনা, (علوم الجرح و التعديل) বিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটে। এভাবে হাদীস পরীা-নিরীা, যাচাই-বাছাই ও ছাঁটাইয়ের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ধারণকারী এক স্বতন্ত্র বিজ্ঞান, হাদীস শাস্ত্রে যৌক্তিক কারণেই স্থান লাভ করে।
(الحديث المحدثون গ্রন্থের ৩১৬-৩৪২ পৃষ্ঠার আলোচনার ছায়া অবলম্বনে)
হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচারের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বনু আব্বাসীয়দের বাদশাহ্ আল-মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ (২৩২ হিঃ) হাদীস সংরণ, সংকলন ও প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। অপরদিকে সংগ্রহ, বাছাই-ছাঁটাই ও সংকলনের পর সহীহ হাদীসের সমন্বয়ে উন্নত ধরনের গ্রন্থ প্রণয়নের কাজও তৃতীয় হিজরী শতকে বিশেষ গুরুত্ব, মর্যাদা, ব্যাপকতা ও গভীরতা সহকারে সুসম্পন্ন হয়। এ বিরাট ও দুরূহ কাজের জন্যে যে প্রতিভা ও দতা অপরিহার্য ছিল তাতে ভূষিত হয়েই আবির্ভূত হন-
১. ইমাম বুখারী (রহ). (১৯৪-২৫৬ হিঃ)
২. ইমাম মুসলিম (রহ.) (২০৪-২৬১ হিঃ)
৩. ইমাম নাসায়ী (রহ.) (২১৫-৩০৩ হিঃ)
৪. ইমাম আবু দাউদ (রহ.) (২০২-২৭৫ হিঃ)
৫. ইমাম তিরমিযী (রহ.) (২০৯-২৭৯ হিঃ)
৬. ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.) (২০৯-২৭৩ হিঃ)
এই ছয়জন মহৎ ব্যক্তি যে হাদীস গ্রন্থ সংকলন করেন সেগুলোই হচ্ছে সর্বাধিক সহীহ হাদীস গ্রন্থ। এ গ্রন্থসমূহ ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও পঠিত। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে এমন কোন স্থান পাওয়া যাবে না যেখানে বুখারী শরীফ পাওয়া যাবে না। হাদীসের এ গ্রন্থসমূহ সংকলিত হওয়ার পর হাদীস সংরণ ও প্রচারের প্রথম ও দ্বিতীয় যুগের ধারা পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ মুখস্থ করার মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারের ধারা পরিবর্তন হয়ে পুস্তক বা গ্রন্থ আকারে সংরক্ষণ এবং পুস্তক পড়ার মাধ্যমে প্রচারের ধারা শুরু হয়ে যায় এবং তা দ্রুতগতিতে প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
হিজরী ৫ম শতক থেকে বর্তমান কাল (হিজরী ১৪৩০ বা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত হাদীস সংরক্ষণ, সংকলন ও প্রচার ব্যবস্থা
এ সুদীর্ঘ সময়ে যে কাজ হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে-
১. হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহের ভাষ্যগ্রন্থ, টীকা ও অন্যান্য ভাষায় তরজামা গ্রন্থ রচিত হওয়া।
২. হাদীসের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার উপর অসংখ্য গ্রন্থ এবং এ সব গ্রন্থের ব্যাখ্যা ও সার সংক্ষেপ রচিত হওয়া।
৩. বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তৃতীয় যুগের গ্রন্থাবলী থেকে নিজেদের আগ্রহ বা প্রয়োজনে হাদীস চয়ন করে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। এ ধরনের কয়েকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে-
ক. মিশকাতুল মাসাবীহ
সংকলক ওয়ালীউদ্দীন খতীব তাবরীযী। নির্বাচিত সংকলন-গুলোর মধ্যে এটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়। এখানে সিহা সিত্তার প্রায় সকল হাদীসসহ আরও দশটি মৌলিক গ্রন্থের হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে।
খ. রিয়াদুস-সালেহীন
সংকলক ইমাম আবু যাকারিয়া ইবনে শরফুদ্দিন নববী (মৃঃ ৬৭৬ হিঃ) এখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কুরআনের আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে।
গ. মুনতাকাল আখবার
ঘ. আত-তাগরীব ওয়াত তারহীব
ঙ. আল-মুহাল্লা
চ. মাসাবীহুস সুন্নাহ ইত্যাদি
৪. কম্পিউটার আবিষ্কার হওয়ার পর কম্পিউটার ডিসকের মাধ্যমে হাদীস সংরণ এবং ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে হাদীস প্রচারের কাজ শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

ভবিষ্যতে হাদীস সংগ্রহ
বিজ্ঞান যেভাবে প্রসার লাভ করছে তাতে মনে হয় সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন রাসূল (সা.) এর সকল কথা মহাশূন্য থেকে উদ্ধার করে সরাসরি তাঁর কণ্ঠে শুনা যাবে এবং তাঁর সকল কাজের ছবি মহাশূন্য থেকে উদ্ধার করে সরাসরি দেখা যাবে। সেদিন মানব সভ্যতা আবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির কথা, কাজ ও সমর্থন সরাসরি তাঁর নিকট থেকে জানতে পারবে। আর তখন একটি হাদীস প্রকৃতভাবে রাসূল (সা.) এর কথা, কাজ বা সমর্থন কিনা এ ব্যাপারে আর কোনই সন্দেহ থাকবে না।

হাদীসের বিভিন্ন অংশ
হাদীস শাস্ত্রে একটি হাদীসকে দু’টি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-
১. সনদ (سند) তথা বর্ণনাকারীদের ধারা বা পরস্পরা এবং
২. মতন (متن) তথা বক্তব্য বিষয়।
চলুন এখন এই সনদ ও মতন সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক-
সনদ (سند) সম্বন্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
হাদীসের এ অংশে থাকে রাসূল (সা.) থেকে শুরু করে যে সকল ব্যক্তির মাধ্যমে হাদীসখানি গ্রন্থকার মুহাদ্দিসের নিকট পৌঁছেছে তাদের নাম। একটি হাদীসের বর্ণনা সূত্রে তথা সনদে মধ্যবর্তী লোকের সংখ্যা যত কম হবে ততো হাদীস বর্ণনায় অনিচ্ছাকৃত তথা মানবীয় ভুলের পরিমাণ কম এবং বর্ণনাকারীদের যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-পর্যালোচনা করা সহজ হয়। তাই বর্ণনাকারীদের স্তরের ভিত্তিতে হাদীসকে নিম্নোক্তভাগে ভাগ করা হয়েছে-
ক. ওয়াহদানিয়াত (وحدانيات)
যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রে রাসূল (সা.) ও গ্রন্থকারের মধ্যে এক স্তরের ব্যক্তি তথা শুধু সাহাবী রয়েছে।
খ. সুনায়ীয়াত (ثنايات)
রাসূল (সা.) ও গ্রন্থকারের মধ্যে যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রে দুই স্তরের তথা সাহাবী ও তাবেয়ী স্তরের বর্ণনাকারী রয়েছে।
গ. সুলাসীয়াত
যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রে রাসূল (সা.) ও গ্রন্থকারের মধ্যে তিন স্তর তথা সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী স্তরের বর্ণনাকারী রয়েছে।
বর্ণনাকারীদের স্তর সংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসসমূহের অবস্থান-
১. কিতাবুল আসার (ইমাম আবু হানিফা র. রচিত)
ওয়াহদানিয়াত – কয়েকটি; সুনায়ীয়াত – অনেকটি
২. মুয়াত্তা (ইমাম মালিক র. রচিত)
ওয়াহদানিয়াত – নাই; সুনায়ীয়াত অধিকাংশ
৩. সুনানে দারেমী (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. রচিত)
সুলাসীয়াত – ১৫ টি ; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট
৪. বুখারী শরীফ :
সুলাসীয়াত – ২২টি; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট

৫. ইবনে মাজাহ :
সুলাসীয়াত – ৫টি; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট
৭. আবু দাউদ :
সুলাসীয়াত – ১টি; বাকি সব – চার স্তর বিশিষ্ট
৮. জামে তিরমিযি
সুলাসীয়াত – ১টি; বাকি সব- চার স্তর বিশিষ্ট
৯. মুসলিম শরীফ :
সব হাদীস চার স্তর বিশিষ্ট।
১০. নাসায়ী :
সব হাদীস চার স্তর বিশিষ্ট।
.